ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বড় দু’দলের বিপরীতমুখী অবস্থান আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় খালেদা জিয়ার বক্তব্য থেকে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গেছে। সাংবিধানিক কারণেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থানও আগে থেকেই পরিষ্কার। বড় দুটি দলই অনড় এ ইস্যুতে। সংকট এখানেই। এ পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থেই বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে দু’দলকে সরে আসতে হবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।
সোমবার আলাপকালে তারা বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দু’দলের নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। সেখানেই দরকষাকষি হবে। চূড়ান্ত হবে ফর্মুলা। এসবের মধ্য দিয়ে সবার অংশগ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বের হয়ে আসবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে না গিয়ে সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারিনি বলেই বারবার এ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এর স্থায়ী সমাধান করতে হলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষের চিন্তাচেতনারও পরিবর্তন প্রয়োজন।
রোববার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নিজ দলের সর্বশেষ অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনের বিষয়ে অনড়। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দেশের মাটিতে আর ফিরে আসবে না। খালেদা জিয়ার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি কোনোদিন পূরণ হবে না। নির্বাচন হবে ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই। দলের অপর এক নেতা বলেন, নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। আর বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা পালন করবে। সংবিধানে এটাই রয়েছে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হচ্ছে- নির্বাচনের আগে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সংসদীয় গণতন্ত্র আছে এমন প্রতিটি দেশে সংসদ ভেঙে দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের মাধ্যমে নির্বাচন হয়। আমাদের দেশেও একইভাবে নির্বাচন হবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত- খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে বক্তৃতা দিয়েছেন তার আক্ষরিক অর্থ ধরলে চলবে না। তার বক্তব্য রাজনৈতিক একটি কৌশল হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। যা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক বা একাধিক নেতা বক্তৃতায় বলছেন। পর্যবেক্ষকরা বলেন, এ জনসভার মাধ্যমে সারা দেশে নেতাকর্মীদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন। তার এ বক্তৃতার মাধ্যমে নেতাকর্মীরা দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়েছেন। এ ধরনের সভা-সমাবেশ অব্যাহত রাখলে অল্প সময়ের মধ্যেই দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো কেটে যাবে বলে মনে করেন তারা।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দু’দলের বিপরীতমুখী অবস্থান প্রসঙ্গে গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান প্রণেতাদের একজন ড. কামাল হোসেন বলেন, সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। তিনি মনে করেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান করতে হলে সব দল, প্রতিষ্ঠান এবং যারা এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তাদের নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। সংলাপ করতে হবে। অন্য কোনো পন্থায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না, ঐকমত্যে পৌঁছা যায় না। তিনি বলেন, দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকতেই পারে। এ মতবিরোধ নিরসনে অর্থবহ সংলাপ প্রয়োজন। জনগণের আস্থা ফেরাতে নির্বাচনের আগেই সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হওয়া জরুরি। ভোটাররা যাতে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে সে ধরনের নির্বাচনই সবাই দেখতে চায়। এতে সব দল যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আরও এক বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশি সময় বাকি। এ সময়ে বড় দু’দলের নেতারা যে বক্তব্য দেবেন তা আক্ষরিত অর্থে দেখার সুযোগ নেই। তারা মাঠের নেতাকর্মীদের কাছে বার্তা দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমরা আশা করতে পারি না যে বিএনপি এখন বলবে প্রধানমন্ত্রীর অধীন তারা নির্বাচনে যাবে। সরকারি দল যেভাবে চাইবে সেভাবেই নির্বাচন হবে। আবার একইভাবে আওয়ামী লীগও তাদের অবস্থানের কথা বলবে। বিএনপি দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেবে- এমনটাও তারা প্রকাশ করবে না। এখনই দুই দল ছাড় দিয়ে বসে থাকবে, এটা আশা করা যায় না।
সা’দত হুসাইন বলেন, রাজনীতি একটা বহমান স্রোত। আজ নেতারা যা বলছেন ছয় মাস পর হয়তো অন্যরকম বলবেন। তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, একটা গ্রহণযোগ্য কর্তৃপক্ষের আওতায় সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হবে। কিভাবে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে সেটা নিয়ে দরকষাকষি হবে, বাকবিতণ্ডা হবে এবং সর্বশেষ সমঝোতা হবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণে দু’দলকে এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। এ জন্য আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। বসলেই একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে। সংকট থেকে উত্তরণে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। এখনও সময় আছে। এর মধ্যেই তারা সমাধানে পৌঁছাতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।
বিশিষ্টজনদের মতে, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দু’দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে দেশে আবারও সংঘাত, সংঘর্ষের রাজনীতি শুরুর আশঙ্কা আছে। এটি দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই খোলা মন নিয়ে তাদের সংলাপে বসে সমস্যা সমাধান করতে হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। তারা মনে করেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কিছু না কিছু ছাড়ের মাধ্যমেই সংলাপ ফলপ্রসূ হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে দু’দলের মধ্যে আবারও বিপরীতমুখী অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা কাম্য নয়। নির্বাচন নিয়ে তাদের অবশ্যই ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকটের একটি সমাধান বের করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, দু’দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে তাদের দলীয় স্বার্থ কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সমাধানে না এলে দেশ আবার চরম অনিশ্চয়তার মধ্য পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বড় দু’দল এক টেবিলে বসলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন এ বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর মতে, এ সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন আনতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধা বাড়াতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জনগণের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই সেখানে এ নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের দেশে সেই মূল্যবোধের আরও অবক্ষয় হচ্ছে।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিশ্বাসী নই। কারণ, তারা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নয়। জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাছাড়া অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সব সময় তাদের বিগত সরকারবিরোধী মনোভাব ছিল। যারা বিরোধী দলে ছিল তাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি কাজ করেছে। বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, নির্বাচনের আরও অনেক সময় আছে। এখনই আলোচনায় বসতে হবে, এটা বলার সময় আসেনি। তিনি আরও বলেন, জনস্রোত থাকলেও কার অধীনে নির্বাচন হল সেটা বড় বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধু ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করেছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, নির্বাচন কোনো সরকারের অধীনে হবে না। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। শেখ হাসিনার সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচন হবে ইসির অধীনে। নির্বাচনের সময় যে সরকার থাকবে তারা শুধু ইসিকে সহায়তা করবে। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দিকেই আমাদের এগোনো উচিত।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার আর বাকি পাঁচ বছরের সরকার ভিন্ন চরিত্রের সরকার। নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে সেটা শেখ হাসিনাই হোক, খালেদা জিয়াই হোক কিংবা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমই হোক তার তো নির্বাচন করার দায়িত্ব নয়।
সেলিম বলেন, আমাদের দেশে এক পক্ষ নির্বাচনে সরকারের প্রভাবকে কাজে লাগাতে চায় আর আরেক পক্ষ তাদের নিজেদের সুবিধামতো সরকার প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে জিততে চায়। কিন্তু নির্বাচন হবে ইসির অধীনে- এ বিষয়টির ওপর সবার গুরুত্ব দিতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন উঠবে না।যুগান্তর