বিবিসি বাংলা : রয়টার্স বলছে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের অনেকেই বাংলাদেশ এসেছে মারাত্মক প্রহার ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে, আবার বাংলাদেশে এসেও তাদের অনেককেই এই বয়সেই বাজে পরিবেশে কাজ সহ নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে হয়রানি ও পাচারের বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়েই রোহিঙ্গা শিশুদের এমন অবস্থার চিত্র উঠে এসেছে আইওএম’র কাছে।
আইওএম’র এসব তথ্য যাচাই করে তার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
তবে কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বিবিসিকে বলেছেন শিশুরা যাতে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে না পড়ে বা তাদের কেউ যেনো অন্য কোথাও নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তারা এগারটি চেকপোস্ট বসিয়েছেন। তিনি বলেন, ” প্রথমত কাউকে ক্যাম্পের বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। ক্যাম্পগুলোতে প্রতিনিধিরা আছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ আছে। শিশুদের সেখানে প্রয়োজনীয় সহায়তা সহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো তারা দেখভাল করছে। তারপরেও কাউকে বাইরে পাওয়া গেলে ক্যাম্পে এনে অভিভাবকদের কাছে দেয়া হচ্ছে। তাদের সব ধরনের সহায়তার জন্যও সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে”।
রাখাইনে সেনাবাহিনী বাকড়িঘর পুকড়িয়ে দেয়া, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতন চালানোর প্রেক্ষাপটে পরিবারসহ কিংবা পরিবার ছাড়া অন্যদের সাথে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শিশুর মোট সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে চার লাখ। যা মোট শরণার্থীর ৫৫ শতাংশ। তবে আইওএম বলছে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্পের জীবন যে রাখাইনের চেয়ে খুব বেশি ভালো তা নয়। চরম দরিদ্রতা আর অপুষ্টিতো রয়েছেই, সাথে আছে এসব শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করানোর জন্য দালালদের তৎপরতা। সাত বছর বয়সী রোহিঙ্গা ছেলে ও মেয়ে শিশুদের বাইরে গিয়ে কাজ করার ব্যবস্থা করারও কিছু তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া গেছে। রয়টার্স বলছে আইওএম ও রোহিঙ্গা অধিবাসীদের অনেকেই জানিয়েছেন অল্প বয়সী বাচ্চাদের অনেকে ফার্ম, নির্মাণ কাজ, মাছ ধরা, চায়ের দোকান চালানো কিংবা রিকশা চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে মেয়ে শিশুরা গৃহপরিচারিকার কাজেই বেশি যাচ্ছে। একজন রোহিঙ্গা শিশুর অভিভাবক জানিয়েছেন তার ১৪ বছর বয়সী কন্যা চট্রগ্রামে এক বাসায় কাজ করেছে এবং পরে পালিয়ে গেছে। এরপর সে যখন ক্যাম্পে ফিরে আসলো তখন সে এমনকি হাটতেও পারছিলোনা। তার মায়ের দাবি, “বাংলাদেশী যাদের কাছে মেয়েটি ছিলো তারা তাকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছে”।
তিনি বলেন, “সেই বাসার মহিলার স্বামী ছিলো মদ্যপ এবং সে রাতে আমার মেয়েকে ধর্ষণ করতো। তারা আমাদের কোন কিছুই দেয়নি, কিছুইনা”। এমন অভিযোগের সত্যতা নিরপেক্ষ সূত্র দিয়ে যাচাই করা যায়নি তবে রয়টার্স বলছে একই ধরনের তথ্য আইওএম এর হাতেও এসেছে। রয়টার্সের দাবি আইওএম বলছে, “রোহিঙ্গা নারীদের যাদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে তাদের অনেকেই যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পরে জোর করে বিয়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিশুদের কাদামাটির মধ্যে একা ও উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরি, বা তাঁবুর বাইরে বসে থাকতে দেখা গেছে। অনেককে সড়কের পাশে ভিক্ষা করতেও দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের পর্যবেক্ষক ইন্টার সেকশন কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ বলছ তারা এ মাসে প্রায় আড়াই হাজার শিশুকে পেয়েছে ক্যাম্পে যারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এবং এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
রয়টার্সের সাথে কথা বলেছে এমন সাতটি রোহিঙ্গা পরিবার জানিয়েছে তারা তাদের শিশুদের কাজে দিয়েছে এবং তারা অল্প বেতনে বাজে পরিবেশে কাজ করছে, নানা ধরনের হয়রানিরও শিকার হচ্ছে। মোহাম্মদ জুবায়ের নামে ১২ বছর বয়সী একটি শিশু জানায় তাকে প্রথমে বলা হয়েছিলো দিনে ২৫০ টাকা দেয়া হবে কিন্তু সড়ক নির্মাণের কাজে ৩৮ দিন থাকার পর তাকে মাত্র ৫০০ টাকা দেয়া হয়েছে। কুতুপালং ক্যাম্পের এই শিশুটির অভিযোগ যে টাকা চাওয়ায় তাকে নির্যাতন সইতে হয়েছে যদিও অভিযুক্তদের পরিচয় প্রকাশ করেনি এই শিশুটি। পরে জুবায়ের একটি চায়ের দোকানে কাজ নেয় এবং সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি কাজ করতে হয় তাকে। একই সাথে তাকে বলা হয়েছিলো কোন ভাবেই যেনো দোকানের বাইরে সে না যায়। শুধু ফোনে অভিভাবকদের সাথে কথা বলার সুযোগ মিলতো তার। “কিন্তু যখন আমাকে টাকা দেয়া হলোনা তখন আমি পালিয়ে আসি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে তারা যদি আবার এসে আমাকে নিয়ে যায়”। আবার আইওএম এর তদন্তে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী অনেক রোহিঙ্গা অভিভাবক নিজেরাই তাদের কন্যাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বিয়েতে রাজী হওয়ার জন্য।
“এদের মধ্যে অনেকেই আসলে পরিণত হয় দ্বিতীয় স্ত্রীতে। এসব দ্বিতীয় স্ত্রীদের প্রায়শই আবার তালাক দেয়া হয়। কোন অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়াই তারা পরিত্যক্তা হয়ে পড়ে”। আইওএম এর একজন পাচার বিরোধী বিশেষজ্ঞ ক্যাটেরাইনা আরদানিয়ান রয়টার্সকে বলেন এ ধরনের নিগ্রহ শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে একটি স্বাভাবিক চিত্র। রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের সুরক্ষায় জরুরি সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তবে ইউনিসেফ ইতোধ্যেই জানিয়েছে যে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য কিছু কার্যক্রম তারা শুরু করেছে। কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ইউনিসেফ অবশ্য ২২৮টি লার্নিং সেন্টার করে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় রোহিঙ্গা শিশুদেরকে অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে।
এ ধরনের লার্নিং সেন্টার বাকড়িয়ে দেড় হাজার করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। আর সেটা হলে হয়তো বেশীরভাগ রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়ার বিষয়টি হয়তো নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ সরকারও জানিয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে জরুরী প্রয়োজনীয় টিকা কার্যক্রম চালানো হয়েছে শিবিরগুলোতে।