ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:বরগুনার পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজ স্টাফ কোয়ার্টারের পেছনে পুকুর থেকে গত ১০ আগস্ট অজ্ঞাত তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর সেই তরুণীর পরিচয় ও নাম ঠিকানা আড়াই মাসেও পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার পাথরঘাটা কলেজের নৈশপ্রহরী জাহাঙ্গীর হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নৈশপ্রহরী গত শনিবার ১৬৪ ধারায় পাথরঘাটার জ্যেষ্ঠ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুরুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। সেই জবানবন্দীর সূত্র ধরে গত শনি ও রোববার অভিযান চালিয়ে পাথরঘাটা থেকে চার ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এর পর থেকেই রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ছাত্রলীগের চারজন নেতার মধ্যে ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আদনান দানিয়াল ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্টকে গত সোমবার দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ওই চারজন গ্রেফতার হওয়ার পরপরই মুখ খুলতে শুরু করেছে পাথরঘাটা কলেজের শিক ও সাধারণ শিার্থীরা। বের হতে শুরু করেছে তাদের অপকর্মের খতিয়ান।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, পাথরঘাটা কলেজে আধিপত্য বিস্তার, শিকদের লাঞ্ছিত করা, ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকরণসহ নানা অপরাধের সাথে ওই চারজন ছাত্রলীগ নেতা জড়িত থাকার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশেষ করে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আদনান দানিয়েল ও সাদ্দাম হোসেনের একচ্ছত্র আধিপত্যে কলেজের সবাই এক প্রকার জিম্মি ছিল। কলেজের ভর্তি, পরীা নিয়ন্ত্রণ ও ফলাফলেও ছিল এই দু’জনের নিয়ন্ত্রণ। অনুসন্ধানে জানা যায়, পাথরঘাটা ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সত্তার মাস্টারের ছেলে দানিয়েল। তার ভাই মোফাচ্ছের ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কলেজের ডিগ্রি চূড়ান্ত বর্ষে অধ্যয়নরত দানিয়েল সরকারি দলের সংসদ সদস্য শওকত হাসানুর রহমান রিমনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়।
এর পরপরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। কলেজ শিকদের লাঞ্ছিত করা, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে আধিপত্য বিস্তারে বিরোধীদের দমনপীড়নে সিদ্ধহস্ত এই নেতার ভয়ে মুখ খোলেনি এত দিন কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগে বেশ কয়েকজন ছাত্রী জানান, কলেজের ভর্তির পরপরই দানিয়েল ও সাদ্দাম সুন্দরী মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এতে রাজি না হলে পথেঘাটে উত্ত্যক্তকরণ, পথেঘাটে হাত ধরে টানাটানি ও কলেজের তৃতীয় তলায় নিয়ে হুমকি দিতো দানিয়েল। এমনকি অভিভাবকদের মুঠোফানে গালিগালাজ ও টেস্ট পরীায় ফেল করিয়ে দেয়ার হুমকি দিতো সে। একইভাবে কোনো ছেলেমেয়ে এক সাথে হাঁটলে তাদের লাঞ্ছিত করে মুঠোফোন কেড়ে নেয়া ও মারধর করত বলেও ওই ছাত্রীরা জানান। আর এসব কাজে তার সহযোগী হিসেবে ছিল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্ট ও সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম রায়হান। বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকরণের একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাদ্দাম পাথরঘাটা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুস সালামের ছেলে।
সে একই কলেজের ডিগ্রি চূড়ান্ত বর্ষে অধ্যয়নরত। সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম রায়হানের বাড়ি কাকচিঁড়া ইউনিয়নে। সে বরিশাল ইনফ্রা পলিটেকনিকে অধ্যয়নরত থাকলেও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের ফুফাতো ভাই হওয়ায় পাথরঘাটা কলেজে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পাদ পায়।
মূলত বহিরাগত হলেও রায়হান সভাপতি ও সম্পাদকের সাহচার্যে কলেজে বেপরোয়া ওঠে। মেয়েদের উত্ত্যক্তকরণ, সাধারণ শিার্থীদের মারধরসহ কলেজের প্রায় প্রতিটি অপরাধের সাথে রায়হানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। গ্রেফতার হওয়া অপর ছাত্রলীগ নেতা উপজেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মো: মাহমুদ ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মিজানুর রহমানের ছেলে। প্রথমে হাফেজি পড়লেও পরে তা ছেড়ে দিয়ে সে পাথরঘাটা ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হয়। বর্তমানে ওই মাদরাসা থেকে দাখিল পরীায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছে সে। পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি বেলাল হোসেনের সাথে বিরোধে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ায় পুলিশ তাকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়াও মাহমুদ একজন মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত। একাধিকবার মাদকসহ তাকে পুলিশ আটক করলেও পরে বিশেষ ফোনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। শুধু শিার্থীই নয়, শিকদের ওপর এই নেতাদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। ভর্তি, পরীার হল নিয়ন্ত্রণ, রেজাল্ট এমনকি কাস পর্যন্ত চালাতে তাদের কথায় বাধ্য হতে হতো শিকদের। এতে প্রতিবাদ করায় একাধিক শিক তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
পাথরঘাটা কলেজে কয়েকজন শিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ বছর আগস্ট মাসে দানিয়েল সাদ্দামসহ অন্য ছাত্রলীগ নেতারা প্রভাষক মিলন মিয়া ও সামসুল আলমকে পরীার হলে কড়া গার্ড দেয়ার জন্য কাসে ঢুকে শিার্থীদের সামনেই লাঞ্ছিত করেছে। তাদের মধ্যে একজনকে শ্রেণী কে আটকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্য জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পাঁচ বছর ধরে দানিয়েল ও সাদ্দাম এবং তার সহযোগীদের কাছে মূলত শিকও শিার্থীরা জিম্মি ছিল। তাদের ভয়ে সাধারণ শিার্থীরা মুখ খুলতে সাহস পায়নি। একাধিক শিককে লাঞ্ছিত করার পর বিচার চেয়েও উল্টো তাদের দলীয় নেতাদের কাছে মাফ চাইতে হয়েছে। এ ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে ওই নেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন উপাধ্য জাহাঙ্গীর।
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক বলেন, ইতোমধ্যেই তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগ কখনোই দুর্বৃত্তায়নের দায়ভার নেবে না। এসব একেবারেই তাদের ব্যক্তিগত অপরাধ। ঘটনায় যদি তারা সম্পৃক্ত থাকে তবে অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। পাথরঘাটা থানার অফিসার ইনচার্জ কর্মকর্তা মো: জিয়াউল হক জিয়া বলেন, রিমান্ড এখনো শেষ হয়নি।