এএসআই নারায়ণের নানা অপকর্ম স্ত্রীর আংটি বিক্রির টাকায় বান্ধবী নিয়ে ফুর্তি

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:  ঘরে, বাইরে, কর্মস্থলে- সব জায়গায় প্রচণ্ড ‘প্রতাপশালী’ ছিলেন এএসআই নারায়ণ চন্দ্র বিপ্লব (৩৯)। বিধি-বিধান, আইন-কানুন, সমাজ-সংসার কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না তিনি। অবৈধ অর্থ উপার্জনের জন্য জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে। নিরপরাধ লোককে ধরে এনে যে থানায় তিনি নির্যাতন চালাতেন অবশেষে সেই থানা পুলিশের হাতেই গ্রেফতার হতে হয়েছে তাকে। সহকর্মীরাই তাকে হাতকড়া পরিয়েছেন। ৩ নভেম্বর থেকে কারাগারে এএসআই নারায়ণ চন্দ্র বিপ্লব। কিন্তু বুধবার পর্যন্ত কোনো স্বজন তাকে দেখতে কারাগারে যাননি। থানা হাজতে থাকা অবস্থায় স্ত্রী মিনাক্ষী বিশ্বাস একবার গিয়ে তাকে ধিক্কার দিয়ে চলে এসেছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এএসআই নারায়ণের নানা অপকর্মের কাহিনী।

জানা যায়, ২ নভেম্বর কেএম দাস লেনের ১৭/২/২ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১৩ পিস ইয়াবা, ৩১ বোতল ফেনসিডিল এবং ১১টি ফেনসিডিলের খালি বোতলসহ নারায়ণকে গ্রেফতার করে ওয়ারী থানা পুলিশ। এ সময় তার বান্ধবী আসমা খানম, মাদক ব্যবসায়ী শেখ শ্যামল ও তানভীর আলম পিন্টুকেও গ্রেফতার করা হয়। এক সন্তানের জনক নারায়ণ ট্যুরিস্ট পুলিশ রংপুরে কর্মরত (বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত)। নারায়ণের বান্ধবী দুই সন্তানের জননী আসমা খানমের স্বামী আলমগীর দেওয়ান আকাশ ব্রাজিলে থাকেন।

নারায়ণের অপকর্মে অতিষ্ঠ স্ত্রী মিনাক্ষী বিশ্বাস  কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘নারায়ণ অনেক পাপ করেছিল। তাই তার এখন এই দুরবস্থা। সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। দেড় রুমের একটি বাসা নিয়ে যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচায় থাকি। বাসা ভাড়া দেয়া তো দূরের কথা, সে বাসায়ই আসত না। বিভিন্ন হোটেলে খারাপ মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাত। বান্ধবীদের বাসায়ও রাতে থাকত।’

তিনি আরও বলেন, আমাদের সাড়ে ৯ বছরের ছেলে নিবিড় এবার যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুলে জেএসসি পরীক্ষার্থী। তার পড়ালেখার কোনো খরচও দিত না। গ্রেফতারের খবর শুনে তাকে থানায় দেখতে যাওয়ার পর পুলিশের কাছে নিজের এসব দুঃখ-দুর্দশার কথা বলি। সদয় হয়ে থানা পুলিশ আমার ছেলের বেতন এবং পরীক্ষার ফি দেয়ার ব্যবস্থা করেছে।

বিয়ের পর থেকেই (১২ বছর) কেঁদে যাচ্ছেন উল্লেখ করে মিনাক্ষী বিশ্বাস বলেন, দায়িত্বে অবহেলা, নৈতিক স্খলন এবং মাদক সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অভিযোগে ওয়ারী থানা থেকে বদলির পর তাকে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে পোস্টিং দেয়া হয়। সেখানে টানা ১৯ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তাকে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশে বদলি করা হলেও সে সেখানে যোগ দেয়নি। পরে ট্যুরিস্ট পুলিশের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে বদলি করা হলে ২৫ অক্টোবর সে সেখানে যোগ দেয়।

মিনাক্ষী বলেন, নারায়ণ প্রথমে রংপুরেও যেতে চায়নি। সেখানে যাওয়ার তিনদিন আগে থেকে সে সার্বক্ষণিক আসমার বাসায় ছিল। আমি আসমার বাসায় গিয়ে অনেক বুঝিয়ে তাকে রংপুর পাঠিয়েছি। তাকে যাতায়াত ভাড়া দিয়েছি। বাসার সামনে থেকে সিএনজিতে উঠে তার সঙ্গে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে সিএনজি থেকে নামিয়ে দিয়ে আসমাকে নিয়ে টার্মিনালে যায়।’

নারায়ণের স্ত্রী মিনাক্ষী আরও বলেন, ‘নারায়ণ রংপুর যাওয়ার পর থাকা খাওয়ার জন্য আমার কাছে টাকা চায়। আমি স্বর্ণের আংটি বিক্রি করে ৩০ অক্টোবর ৩ হাজার টাকা দিই। ২ নভেম্বর আমার বাবা তাকে ৫ হাজার টাকা দেন। ওই টাকা পাওয়ার পর সে আমাদের কিছু না জানিয়ে, অফিস থেকে ছুটি না নিয়ে ঢাকায় এসে বান্ধবী নিয়ে ফুর্তি করে। বান্ধবীসহ নারায়ণ গ্রেফতার হওয়ার পর তার ঢাকায় আসার বিষয়টি জানতে পারি।’

মিনাক্ষী বিশ্বাস জানান, ডিউটি ফাঁকি দিয়ে নারায়ণ নানা অপকর্ম করে বেড়াত। ওয়ারী থানায় কর্মরত অবস্থায় একদিনের ঘটনার বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘তাকে ফোন দিয়ে অবস্থান জানতে চাইলে বলেন, তিনি জরুরি কাজে থানায় আছেন। পরে থানায় গিয়ে জানতে পারি, আমার অসুস্থতার কথা বলে সে থানা থেকে বেরিয়ে গেছে। বিষয়টি থানার ওসিকে জানালে ওসি নারায়ণকে ফোন করে তার অবস্থান জানতে চাইলে বেরিয়ে আসে, সে তখন বাইরে খারাপ কাজে লিপ্ত ছিল।’

মিনাক্ষী জানান, প্রায় এক বছর আগে আসমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর নারায়ণ চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা সব ভুলে যায়। আসমার ৬ষ্ঠ শ্রেণী পড়–য়া মেয়ে রুমাকে নিজের মেয়ে এবং তৃতীয় শ্রেণী পড়–য়া ছেলে নিলয়কে নিজের ছেলে মনে করত। তাদের নিয়ে হাত ধরে ঘুরত। অথচ নিজের ছেলে নিবিড় নারায়ণের হাত ধরলে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিত।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গ্রেফতারের খবর শুনে আমি থানায় গেলে নারায়ণ আমাকে বলে, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না। দুই-একদিন জেলখানায় থাকব। এরপর চলে আসব।’

এ বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি সোহরাব হোসেন বলেন, ‘পুলিশের একজন সদস্য মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়াবে তা কাম্য হতে পারে না। নারায়ণ কয়েক মাস আগে ট্যুরিস্ট পুলিশে যোগ দিয়েছে। মাদকদ্রব্যসহ গ্রেফতার হওয়ার পর একবাক্যে সবাই বলেছে, সে খারাপ লোক।’

ডিআইজি সোহরাব জানান, মাদক মামলায় সাধারণত চার্জশিট হয়। তার বিরুদ্ধেও চার্জশিট হতে পারে। গ্রেফতারের পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আদালতে সাজা হলে তাকে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হবে।

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘ওয়ারী থানার ওসির দেয়া গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাকে বদলি করা হয়। এর পরও সে ওয়ারী এলাকায় এসে অপরাধ তৎপরতায় লিপ্ত হয়। একটি ঘটনায় তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে আইনের আওয়ায় আনা হয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের মে-জুনে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের তৎকালীন উপ-কমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলামের কাছে এএসআই নারায়ণের বিরুদ্ধে একাধিক গোপনীয় প্রতিবেদন জমা দেন ওয়ারী থানার তৎকালীন ওসি জেহাদ হোসেন। প্রতিবেদনগুলোর অনুলিপি যুগান্তরের কাছে এসেছে।

ওইসব প্রতিবেদনে বলা হয়, এএসআই নারায়ণ চন্দ্র বিপ্লবের বিরুদ্ধে মাদকসহ অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যোগদানের পর থেকেই ডিউটি পালনে তিনি ছিলেন অনিয়মিত। ডিউটিতে গেলেও ডিউটি শেষ হওয়ার আগেই ডিউটিস্থল ত্যাগ করতেন। রাত্রিকালীন ডিউটির পর সব অফিসারকে রাত ২টায় থানায় হাজির হওয়ার বিধান থাকলেও তিনি থানায় আসতেন না। থানায় বিভিন্ন জরুরি ব্রিফিংয়ে প্রায়ই তিনি অনুপস্থিত থাকতেন। নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে ওয়ারী থানায় তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। পরিবারের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে থানায় বেশ কয়েকবার মৌখিক অভিযোগ দেয়া হয়।

সূত্র জানায়, নারায়ণকে ওয়ারী থানা থেকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলির জন্য গত বছরের ৬ এপ্রিল পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ মে তাকে ওয়ারী থানা থেকে ট্যুরিস্ট পুলিশে বদলির আদেশ দেয়া হয়। ওই বছরের ৩০ মে ওয়ারী থানা থেকে ছাড়পত্র নেন নারায়ণ।যুগান্তর

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।