ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:নির্বাচনে যেতে আন্তরিক বিএনপি। তবে নির্বাচনের জন্য অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা সরকারের দায়িত্ব’- এই বিষয়টিকে আলোচনায় রাখতে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ দিলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পাশাপাশি নেতাদের জনসম্পৃক্ততা ও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
শনিবার (১৮ নভেম্বর) রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠকে এ পরামর্শ দেন বিএনপি প্রধান। এদিন রাত সাড়ে নয়টায় শুরু হয়ে বৈঠকটি রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে শেষ হয়। বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে বেশিরভাগই আলোচনায় অংশ নেন।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসার পর বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে অন্তত সাত জন ভাইস চেয়ারম্যানের কথা হয়। তারা জানান, খালেদা জিয়া পুরো বৈঠকে আলোচকদের কথার মাঝেই নিজের কথা যুক্ত করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিট কথা বলেন তিনি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ভাইস-চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া তার আলোচনায় আগামী নির্বাচনে যেতে বিএনপি আন্তরিক ও ইচ্ছুক বলে জানান। তবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সরকারের দায়িত্ব, এই কথাটিও আলোচনায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন নেতাদের।
রাত সাড়ে নয়টায় বৈঠক শুরু হলে প্রথমেই আলোচনা করেন ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। তিনি খালেদা জিয়ার দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে বিমানবন্দরে মানুষের ঢল, কক্সবাজার সফরে নেতাকর্মী ও মানুষের উপস্থিতি এবং বিভিন্ন বাধা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসমাবেশে লাখো মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার তাগিদ দেন। এছাড়া, এই সময়ের প্রধান ইস্যুগুলোকে নিয়ে বেশি বেশি কথা বলতে বলেন নেতাদের। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে আরও সরব হওয়ার আহ্বান জানান। বৈঠকে রোহিঙ্গা বিষয়ে সরকারের আচরণ ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়ে কথা ওঠে।
আলোচনায় অংশ নেওয়া একজন ভাইস চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সরকার এতদিন চীন, ভারত, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলে আসলো, কিন্তু জাতিসংঘে কেউই বাংলাদেশের পাশে নেই। প্রতিবেশী দেশগুলোর আচরণ অবাক করে দিলো। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটানের আচরণ তো বিস্ময় এনে দিলো সবাইকে। মিয়ানমারের এত অত্যাচার সত্ত্বেও কী এমন সোনারকাঠি তাদের হাতে গেল যে, প্রতিবেশী দেশগুলোও বাংলাদেশের পক্ষে রইলো না।’
আক্ষেপ করে এই ভাইস চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘সরকারের প্রয়োজন ছিল সারাজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু খালেদা জিয়ার বারবার আহ্বান করার পরও তারা ভ্রুক্ষেপ করেনি।’ এই নেতা আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বা সরকার যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, সব ব্যর্থ হয়েছে।’
বৈঠক সূত্র জানায়, ভাইস চেয়ারম্যানরা তাদের বক্তব্যে আগামী দিনেও খালেদা জিয়াকে জেলায় জেলায় সফরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকেই দেশে ফেরা, কক্সবাজার সফর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের জমায়েত নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন বাধা থাকলেও মানুষ পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে আগামী দিনেও নেত্রীকে সফরে বের হওয়ার কথা বলেছেন তারা। তবে সমাবেশে কোনও ধরনের বড় উদ্যোগ বা অর্থ ব্যয় ছাড়াই যে মানুষের সমাগম হয়েছে, তাতে দল অভিভূত বলে জানান একাধিক ভাইস চেয়ারম্যান।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, খালেদা জিয়া নিজেও মিটিং করবেন বলে জানিয়েছেন। কবে থেকে সফর শুরু হবে, এ বিষয়টি সিদ্ধান্ত আরও পরে হবে। ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক হলো, এরপর উপদেষ্টা ও মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে স্থায়ী কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
সূত্র জানায়, বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে আলোচনা করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, শাজাহান ওমর, মো. শাহজাহান, মীর নাছির, গিয়াস কাদের চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন, হারুন আল রশীদ, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ডা. এজেড জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, আহমেদ আযম খান প্রমুখ।
সূত্রের ভাষ্য, আলোচকদের কথার মূল ফোকাস ছিল- আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তবে আগে সংগঠনকে গুছিয়ে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার অধীনে নয়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং সেটি তত্ত্বাবধায়ক নয়, এই দাবি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। শান্তিপূর্ণ সমন্বিত রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় করা এবং এ জন্য সহায়ক কর্মসূচিগুলো দিতে হবে। এর আগে গত ১৫ নভেম্বর ২০ দলীয় জোটের বৈঠকেও খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আন্দোলন শব্দটি নয়, রাজনৈতিক কর্মসূচি শব্দটি সামনে আনতে হবে।’
অন্য একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, বৈঠকে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করেননি। তবে তিনি নির্দলীয় সরকারের কথা বলেছেন এবং সংগঠন গুছিয়ে সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবেন।
বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, আগামী নির্বাচন, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার জন্য যতগুলো কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন, সব গ্রহণ করা।
বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেকটি সূত্র মতে, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। নেতারা যেন নিজেদের গ্রামে যান, এলাকায় আসা-যাওয়া বাড়ান, এ পরামর্শ দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন আল রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈঠকে অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে বলেছেন ম্যাডাম।’
বিএনপির মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, শনিবার রাত সাড়ে এগারোটায় ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক শেষ হয়।
খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উপস্থিত ভাইস চেয়ারম্যানরা হচ্ছেন, এম মোরশেদ খান, হারুন আল রশীদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, অধ্যাপক আবদুল মান্নান, আবদুল মান্নান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, মীর নাসির, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, অধ্যাপক ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, গিয়াস কাদের চৌধুরী ও শওকত মাহমুদ।