ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারের সাথে চুক্তি হচ্ছে। চুক্তির শর্তাবলি নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। আগামী ২২ ও ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিডোতে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শর্তাবলির খুঁটিনাটি নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতার পর চুক্তিটি সই হবে।
এ দিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় পৌঁছাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সাথে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠকে ওয়াং ই এ নিশ্চয়তা দেন। বেলা ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমসহ দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর পর আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতে চীন ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মিয়ানমার। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশ দু’টির সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় চীন ও রাশিয়া জাতিসঙ্ঘে মিয়ানমারের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। ক্ষমতাধর এই দুই দেশের বিরোধিতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো বারবার চেষ্টা করেও নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব অনুমোদন করতে পারেনি।
কেবল নিরাপত্তা পরিষদই নয়, গত বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) উত্থাপিত প্রস্তাবে বিপক্ষেও ভোট দিয়েছে চীন-রাশিয়াসহ মিয়ানমার সমর্থক ১০টি দেশ। তবে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৩৫টি। তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত এই প্রস্তাব আগামী ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদের প্ল্যানারিতে উপস্থাপিত হবে।
সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাব মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও এর আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা চীন ও রাশিয়া।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনকে অন্তত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বাংলাদেশের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও রাশিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটি চোখে পড়ছে না। ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমনাভিযান শুরু হলে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দূত দু’বার বাংলাদেশ সফর করেছেন। এবার এলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু রাশিয়ার উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি এ ইস্যুতে আলোচনার জন্য বাংলাদেশে আসেননি। এমনকি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার জন্য মস্কো যেতে চাইলেও রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেয়া হয়নি। অবশ্য গত সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের সাথে মাহমুদ আলীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, চীন বরাবরই মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে উৎসাহিত করে আসছে। আর সরকার বলছে, দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই বাংলাদেশ ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তবে মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার পথ এখনো খোলা রাখা হয়েছে। এ জন্যই নেইপিডোতে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ইতিবাচক অগ্রগতি আশা করছে বাংলাদেশ।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর শেষে এশিয়া-ইউরোপ বৈঠকে (আসেম) যোগ দিতে আজ রোববার সকালে নেইপিডো যাবেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী যাবেন রাতে। এই বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০ ও ২১ নভেম্বর আসেম সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রী (হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ) ফেডিরিকা মোঘেরিনি, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্টার ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো আজ ঢাকা আসছেন।
সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে প্রত্যাবাসন চুক্তি : মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সেক্রেটারি ইউ কিইয়াও জেয়া জানিয়েছেন, চারটি শর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নেইপিডো নীতিগতভাবে সম্মত রয়েছে। শর্তগুলো হলোÑ মিয়ানমারে দীর্ঘ দিন বসবাসের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে, পরিবারের কেউ রাখাইন রাজ্যে রয়েছেন এমন প্রমাণ দেখাতে হবে, বাংলাদেশে জন্ম নেয়া শিশুর বাবা-মা উভয়কেই মিয়ানমারের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে প্রমাণ দিতে হবে এবং রাখাইনে স্বেচ্ছায় ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে হবে।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সাথে ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী নতুুন চুক্তি করতে চায় মিয়ানমার। এই চুক্তির আওতায় কেবলমাত্র ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারাই মিয়ানমার ফিরতে পারবেন। এ ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার তৃতীয় কোনো পক্ষের অন্তর্ভুক্তিতেও আগ্রহী নয়।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমার যে চারটি শর্তের উল্লেখ করেছে সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের তেমন কোনো আপত্তি নেই। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী নয়, বরং এর ভিত্তিতে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কিছু সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তি করতে চায়। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চির দফতরের মন্ত্রী গত মাসে ঢাকা সফরের পর দুই দেশের মধ্যে অন্তত তিনবার চুক্তির খসড়া বিনিময় হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে বসবাসের প্রমাণপত্র হিসেবে মিয়ানমার যেকোনো ধরনের পরিচয়পত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, এমনকি মেডিক্যালে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রও মেনে নিতে রাজি।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশ বলেছে, বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার কারণে যেসব রোহিঙ্গা কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারবে না, তাদের পরিচয় যাচাইয়ের একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি রাখাইনে তার বাড়ির ঠিকানা বলতে পারলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তা যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত করতে পারে। এ ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার জন্য তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরাসরি আপত্তি না জানালেও ইউএনএইচসিআরের কাজের পরিধি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে দরকষাকষি করছে। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের আগে আসা প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। নেইপিডো বৈঠকে তা চূড়ান্ত হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, নেইপিডো বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি করতে মিয়ানমার আগ্রহী তাদের নিজেদের স্বার্থেই। তা না হলে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ার দায় তাদের ওপরেই বর্তাবে। তাই চুক্তি যে হবে, তা এক ধরনের নিশ্চিত। শর্ত নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে দরকষাকষি হবেই। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন চুক্তি সইয়ের পর তা বাস্তবায়নের জন্য জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এই গ্রুপ গঠন করা হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নেইপিডো সফরের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমার।
নেইপিডোতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থাকবেন।
চার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজ কক্সবাজার যাবেন : ইইউ, জার্মানি, সুইডেন ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শনিবার রাত ও আজ ভোরে ঢাকা এসে পৌঁছাবেন। এরপর সকাল সাড়ে ৯টায় মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে চার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে কক্সবাজার যাবেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে তারা ঢাকা ফিরে আসবেন। এরপর চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে এক ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক পৃথকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। রাতে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ বিমানে মাহমুদ আলী নেইপিডোর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাবেন। পররাষ্ট্রসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত ফ্লাইটে ব্যাংকক হয়ে নেইপিডো পৌঁছাবেন।
চুক্তিতে নজর রাখবে মালয়েশিয়া : বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তিতে নজর রাখবে মালয়েশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফ আমান গতকাল স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সই হতে যাওয়া চুক্তির প্রতি নজর রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ন সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া উচিত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার কী কী শর্ত আরোপ করছে তা জানার জন্য আমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ রাখব।’
এ দিকে বাংলাদেশের সাথে সব বিষয়ে সহযোগিতা করতে মিয়ানমার প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারের তথ্যমন্ত্রী ড. পি মিন্ট। গতকাল নেইপিডোতে ইউএনবিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী হিসেবে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা করতে চায় মিয়ানমার।