মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে ‘অপরাধস্থল’ আখ্যা দিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এ অঞ্চলটি এখন রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘উন্মুক্ত কারাগার’ ও ‘ছাদবিহীন খাঁচায়’ পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট জাতিবিদ্বেষ ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের জালে আটকে পড়েছে রোহিঙ্গারা। একে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘বর্ণবাদী প্রথা’র সঙ্গে তুলনা করে সেখানে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের আলাদা করছে কর্তৃপক্ষ। এটা করা হচ্ছে বর্ণবাদী অমানবিক এক ব্যবস্থায়। সেখানে প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটা আরও তীব্রতর হয়েছে।
রাখাইনে দু’বছর অনুসন্ধান শেষে মঙ্গলবার ‘কেজড উইদাউট এ রুফ’ বা ‘ছাদবিহীন খাঁচায় বন্দি’ শীর্ষক ১১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এ তদন্তে রাখাইনে বর্তমানের রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ উদঘাটিত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে পর্যায়ক্রমে যে মাত্রার বৈষম্য চালানো হয় তা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। তারা পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। নির্বিচারে করেছে ধর্ষণ। এসব নৃশংসতার কারণে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে অন্তত ৬ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা।
অ্যামনেস্টির গবেষণাবিষয়ক সিনিয়র পরিচালক আনা নেইস্টাট বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিরাশ করে তোলা এবং যতটা সম্ভব মানবাধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য সবকিছু সাজানো হয়েছে।’
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার মূল কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের বহু বছর ধরে চালানো বৈষম্য ও নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চলমান সংকট ডেকে এনেছে, প্রতিবেদনে তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আনা নেইস্টাট বলেন, ‘মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এসব রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অমানবিক ও চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে চলেছে।’ তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্য একটি অপরাধস্থল। তিন মাস ধরে চলা সামরিক বাহিনীর তাণ্ডবের আগে থেকেই এসব কারণ বিদ্যমান ছিল।’ বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মুসলিম এই জনগোষ্ঠীকে চরম ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়। ১৯৮২ সালের দমনমূলক নাগরিক আইন প্রণয়নের পর থেকে তাদের ওপর এ বৈষম্য চলে আসছে। আইনটি প্রণয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সব ধরনের অধিকার হরণ করা হয়। তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয় না। দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ ‘বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করে আসছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে সাম্প্রতিক এ সহিংসতার আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। তারা স্বাধীনতভাবে কোথাও যেতে পারে না। রাজ্যের বাইরে যেতে হলে তাদের অনুমতি দরকার হয়। একাধিক চেকপয়েন্ট বসিয়ে তাদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়। ২০১২ সালে একবার সহিংসতা দেখা দেয়ায় রোহিঙ্গাদের বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকে পৃথক করে রাখা হয়। তাদের তারকাঁটার বেড়া দেয়া ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের সামনে রয়েছে পুলিশি চেকপয়েন্ট। রোহিঙ্গা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা যায় না। হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা মেলে না। অ্যামনেস্টি একে উন্মুক্ত কারাগার বলে মন্তব্য করেছে।
ক্যাম্পের বাইরে যেতে হলে তাদের একের পর এক চেকপয়েন্ট পার হতে হয়। এ সময় বর্ডার গার্ড পুলিশকে তাদের ঘুষ দিতে হয়। তারা নিপীড়ন চালায় রোহিঙ্গাদের ওপর। একজন প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা যুবক অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, একটি বাসে করে তারা যখন যাচ্ছিলেন তখন সেটি থামানো হয়। এ সময় চেকপয়েন্টে চারজন পুলিশ ছিল। এ সময় দু’জন পুলিশ পুরুষদের লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। আরেকজন এক নারীকে ৪-৫টি ঘুষি মারে। এরপর তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। অন্য এক ঘটনায় অ্যামনেস্টির গবেষক নিজেই দেখতে পান যে, একজন রোহিঙ্গা কারফিউর মধ্যে বের হলে তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। অ্যামনেস্টি বলেছে, নিপীড়নের ফলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ণবাদী ব্যবস্থার মধ্যে ফিরে যেতে বলা যায় না।
জাতিসংঘের জরুরি বৈঠকের আহ্বান : মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে জরুরি বৈঠকে বসার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ৩৫টি আন্তর্জাতিক সংস্থা। অ্যামনেস্টিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা সোমবার রাতে লেখা এক চিঠিতে বলেছে, ‘আমরা জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কাছে মিয়ানমারের ক্রমাবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য অবিলম্বে জরুরি বৈঠক ডাকার জোর আহ্বান জানাচ্ছি।’