ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:ঢাকা: ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের দু:সহ সেই স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ওই ঘটনায় নিহত-আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের।
ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন- এমন দাবি শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর। তবে, বিজিএমইএ বলছে-সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বঞ্চিতদের সহায়তা দিতে এখনও প্রস্তুত তারা।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর, সন্ধ্যার পরপরই জ্বলে ওঠে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন গার্মেন্টস। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেন আট তলা ভবনে কর্মরত কর্মীরা। কিন্তু ভবনের প্রধান ফটক তালাবন্ধ থাকায় সেদিন আগুনে পুড়ে প্রাণ হারান তাজরিনের ১১৩ জন শ্রমিক। আর বাকিরা প্রাণে বেঁচে গেলেও অনেকেই আহত হন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের চোখে এখনও জ্বলজ্বলে সেদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, প্রথমে আগুন লাগলে বুঝতে পারিনি আমরা। কাজ বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করি সবাইকে, কি হয়েছে? এরপরেই দেখি পুরো ফ্লোর ধোঁয়ায় অন্ধকার। অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি। লাশের চিহ্নও পাওয়া যায়নি এমন কি টাকা পয়সাও পাওয়া যায়নি।
দুর্ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসাসহ ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয় সরকার, বিজিএমইএ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। তবে, সে সব পদক্ষেপে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে বঞ্চিতদের সহায়তা করার দাবি জানায় শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
তারা বলেন, আহত শ্রমিকরা এখনো সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। যারা দোষী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। কলকারখানা পরিদর্শক যদি এই ভুল করে থাকে তারও শাস্তি হওয়া উচিত।
তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিজিএমইএ জানায়, ওই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও সত্যিকারের বঞ্চিতদের সহায়তা করতে তাদের আন্তরিকতার অভাব নাই।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি যদি এই দুর্ঘটনায় কোন শ্রমিক চিকিৎসা ঠিকমত না পেয়ে থাকেন বা পাওয়া না পেয়ে থাকেন তাহলে তারা যেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কোনো অভিযোগ পায়নি।
সেদিনের অগ্নিকাণ্ডে বেশি মাত্রায় পুড়ে যাওয়ায় ৫৩ জনের লাশ আজও সনাক্ত করা যায়নি। যাদের ঠাঁই হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে।
মানুষকে হত্যা করে মালিক কিভাবে ছাড়া পায়?
এদিকে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচারে তেমন কোন অগ্রগতি নেই তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের মামলার। ২০১৫ সাল থেকে এপর্যন্ত ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র ৭জনের।
দেশে এমন বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলেই এই ঘটনার বিচার বিলম্বিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতে সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
দীপ্তিরাণী অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন তাজরীন ফ্যাশনে। দুর্ঘটনার সময় ভবনের তিন তলা থেকে বের হতে গিয়ে গুরুতর আঘাত পান তিনি। হারান সন্তান গ্রহণের সক্ষমতা। সেই ঘটনার পর থেকে চরম অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে তার। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের অনেকেই সেই ঘটনায় দীপ্তিরাণীর মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।
মামলার বিচার বিলম্বিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, আদালতে সাক্ষী না আসার কারণে এগুতে পারছেনা বিচারকাজ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘আইও যখন এই মামলার তদন্ত করে তখন ভাড়াটিয়াদের বর্তমান ঠিকানা নিয়েছেন ওদের স্থায়ী ঠিকানা নেয়া হয়নি। সাভারের ঠিকানায় সমন গেলে সাক্ষীদের পাওয়া সম্ভব হয়না।’
শ্রমিকদের অভিযোগ এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে তাজরীনের মালিকপক্ষের যথেষ্ট অবহেলা ছিল। এখনও তারা এই বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, ‘এতজন মানুষকে হত্যা করে কিভাবে মালিক ছাড়া পায়। আমরা মালিকের বিচার চাই।’
রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী না আসার অজুহাত দিলেও অনুসন্ধানে দেখা যায় আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সেদিনের ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন যাদের নাম সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়নি।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটির বিচারের জন্য ১০৪ জন সাক্ষীর প্রয়োজনই নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে বিচার হীনতার সংস্কৃতির কারণেই এমনটা হচ্ছে। ১০০ সাক্ষী যুক্ত করায় হচ্ছে বিচার না করার একটা ব্যপার।
তবে এ ঘটনার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি চান বলে জানান আসামি পক্ষের আইনজীবীও। ২০১২ সালের এই দিনে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১১৩ জন ও আহত হন কয়েকশ পোশাক শ্রমিক। এঘটনায় তাজরীনের মালিকসহ ১৩জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয় পুলিশ। এমামলার ৯ আসামি জামিনে থাকলেও বাকিরা পলাতক।