মতিউর রহমান : ডিসেম্বর মাস থেকেই গ্রাহক পর্যায়ে আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর ফলে প্রতি মাসে বাড়তি টাকা গুণতে হবে ভোক্তাদের। আওয়ামী লীগ সরকারের দু’দফা মেয়াদকালে এবার অষ্টমবারের মতো বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। এবার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে বাড়ানো হয়েছে ৩৫ পয়সা যা আগের তুলনায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। যদিও ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মতামত উপেক্ষা করেই শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের এই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিল সরকার। তবে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য দাম বাড়ছে না, বরং তাদের মিনিমাম বিল প্রত্যাহার করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুরেটরি কমিশন বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাস থেকেই গ্রাহকদের এই বর্ধিত বিল পরিশোধ করতে হবে। তারা আরো জানিয়েছে, এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে কেবল খুচরা পর্যায়ে; পাইকারিতে বিতরণ কেন্দ্রেগুলোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান মোনোয়ার হোসেন আরো বলেন, বিদ্যুতের ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশ বা ৩০ লাখ লাইফ লাইন গ্রাহকের (০-৫০ ইউনিট) বিদ্যুৎ বিল হ্রাস পাবে।
তাছাড়া বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বাপবিবো) প্রায় ৬০ লাখ ( মোট গ্রাহকের ২৫ শতাংশ) লাইফ- লাইন গ্রাহকের জন্য খুচরা বিদ্যুৎ মূল্যহার অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ সারা দেশে মোট গ্রাহকের প্রায় ৩৮ শতাংশেরই বিল বৃদ্ধি পাবে না।
তিনি বলেন, সেচের জন্য যেসব কৃষকরা বিদ্যুৎ নিয়ে থাকেন; তারা একটা মওসুম বিদ্যুৎ নিয়ে থাকেন। অন্য সময়ে তারা বিদ্যুৎ নেন না। তাই অন্য সময়ে জন্য আর তাদের বিদ্যুৎ খরচ দেওয়া লাগবে না। এই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকার ও কোম্পানিগুলোর মোট ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা আয় বাড়বে।
বিইআরসি আরো জানিয়েছে, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এই ঘোষণায় দরিদ্র কম ব্যবহারকারী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দাম বাড়বে না। তবে এত দিন তাদের যে ন্যূনতম বিল (মিনিমাম চার্জ) দিতে হতো, সেটা আর থাকবে না। মিনিমাম চার্জ তুলে দেওয়ার ফলে ৩০ লাখ দরিদ্র গ্রাহক উপকৃত হবে। আর সাত লাখ বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়বে।
তবে পাইকারি ক্ষেত্রে দাম না বাড়ার কারণ হচ্ছে সরকার সেখানে ভর্তুকি দেবে। তাতে বছরে ৩৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়কে পাইকারি দাম হিসেবে ধরা হয়। উল্লেখ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত আটবার বাড়ানোর হল বিদ্যুতের দাম। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। তাতে মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়ে ২০ টাকা; ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারে খরচ বাড়ে কমপক্ষে ৩০ টাকা।
অবশ্য চলতি বছরের গত মার্চে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করা প্রয়োজন।
এরপর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গত সেপ্টেম্বরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে শুনানির আয়োজন করে। সেখানে পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব আসে।
এর মধ্যে ডিপিডিসি গ্রাহক পর্যায়ে ৬.২৪ শতাংশ, ডেসকো ৬.৩৪ শতাংশ, ওজোপাডিকো ১০.৩৬ শতাংশ, আরইবি ১০.৭৫ শতাংশ এবং পিডিবি ১৪.৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, গণশুনানি করার পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানাতে হয়।
এবারও শুনানিতে বিতরণ সংস্থাগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয় ভোক্তাদের পক্ষ থেকে। ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষ থেকে দাম কমানোর একটি প্রস্তাব নিয়েও শুনানি হয়।
এদিকে শুরু থেকেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে হরতাল দিয়ে তার প্রতিবাদ জানানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল বাম দলগুলো। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এল।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিইআরসির সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়, খুচরা পর্যায়ে গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুতের ন্যুনতম চার্জ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে মাসে ৫০ ইউনিটের কম ব্যবহার করেন এমন প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহকের (মোট গ্রাহকের ১৩ শতাংশ) বিদ্যুৎ বিল কমবে।
এই দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের ( মোট গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ) মাসিক বিল মোটেও বৃদ্ধি পাবে না বলেও বিইআরসির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।