বাংলাদেশ মিয়ানমার সমঝোতা স্মারক উপেক্ষিত বাংলাদেশের দাবি

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: ঢাকার কয়েকটি দাবিতে সাড়া না দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। গতকাল বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদোতে দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির কার্যালয়ে দুই দেশের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশের কিছু দাবিতে সাড়া দেয়নি মিয়ানমার। এসময় তারা ১৯৯৮ সালে স্বাক্ষরিত দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তিতেও অনুসমর্থন দেন।

বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, সমঝোতা স্মারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কাজ স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে শুরু করার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে কতদিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার এই কাজ শেষ হবে সেব্যাপারে নির্দিষ্ট সময় সীমা বেঁধে দিতে রাজি হয়নি মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা চায় বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার বাংলাদেশের সব দাবিতে সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যদিও আমাদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নেয়নি মিয়ানমার; তারপরও আমরা অনেক ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছি। যে কোনো ধরনের আলোচনায় এটা সম্ভবও নয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বৈঠকে বসেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ব্যাপী এই বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে তারা আলোচনা করেন।

এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর সই হলো। তারা (মিয়ানমার সরকার) রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। এখন কাজটা শুরু করতে হবে। ১০ লাখের কাছাকাছি আসা রোহিঙ্গা ফেরাতে কতদিন লাগবে জানতে চাইল তিনি বলেন, কাজটা শুরু করাই বড় কথা। কতদিন লাগবে তা এখনই নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। কারণ রাখাইনে যেখান থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছেন তাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেওয়া; সেগুলো তৈরি করতে হবে। এর বেশি তিনি আর কথা বলেননি। কেবল বলেছেন, পরশুদিন ঢাকায় ব্রিফ করা হবে। পরশু দিন অর্থাৎ আগামী শনিবার (২৫ নবেম্বর) এ বিষয়ে ঢাকায় সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরা হবে ।

রোহিঙ্গাদের ফেরতের ইস্যু ছাড়াও নাফ নদীর সীমানা রেখা বিনিময় বিষয়ক আরও একটি স্মারক সই হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাহমুদ আলী। এছাড়া তারা ১৯৯৮ সালের সীমান্ত নির্ধারণী চুক্তি নবায়নে স্মারক বিনিময় করেন। এর আগে সকালে প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠকে বসেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খুব ভালো আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার আগে বুধবার সমঝোতার খসড়া নিয়ে দিনভর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ছাড়াও মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন।

প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এটি তৃতীয় উদ্যোগ। এর আগে ১৯৭৮ সালে দুই দেশ চুক্তি করে। যার অধীনে দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ছয় মাসের মধ্যে ফেরত যায়। পরে ১৯৯২ সালে দুই দেশের মধ্যে আরেকটি সমঝোতা হয়, যার অধীনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়।

চলতি বছরের ২৪ আগস্টের পর থেকে অব্যাহত অত্যাচারে এখন পর্যন্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সাত লাখের বেশি বলে জাতিসংঘ জানাচ্ছে। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও লাখ খানেক বেশি। এছাড়া আগে থেকেই চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে থাকেন। এতে মোট রোহিঙ্গা সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কাজ শেষ করতে চায় ঢাকা। যদিও মিয়ানমার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ছাড়াই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে চায়।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সংস্থাসমূহের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে মিয়ানমার নমনীয় অবস্থান দেখালেও কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে সব রোহিঙ্গা ফেরত নিতে দুই দেশের পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে একমত হয়েছে।

সংকট সমাধান হবে না: রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সময়সীমা এবং প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে তৃতীয় কোনো দেশের সহযোগিতা চাওয়া যাবে কি না- ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হলেও সে ব্যাপারে কিছুই সুনির্দিষ্ট করা হয় নি।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এ সমঝোতা স্মারক সই প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম এর সাধারণ সম্পাদক জমির উদ্দিন গণমাধ্যমকে তার হতাশার কথা ব্যক্ত করে বলেন, এর ফলে সংকটের সমাধান হবে না। সংকট দীর্ঘায়িত হবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে গতকাল দুই পক্ষ দীর্ঘ আলোচনা করেছে। বিশেষ করে সমঝোতা স্মারকটির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চূড়ান্ত না হওয়ায় এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নাকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১০ লাখের সবাইকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, ফেরত পাঠানোর আগে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ে জাতিসংঘকে রাখা হবে কী না এবং রাখাইনে ফেরত পাঠানোর পর রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন করা হবে কি না।

মিয়ানমার সরকার যা বলে: মিয়ানমারের সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাস্তু-চ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঘটবে তাদের পরিচয় যথাযথভাবে যাচাই করার পর। বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৯২ সালে দুই দেশের তরফে যে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয় তার মধ্যে এই বিষয়ে দিক নির্দেশনা এবং নীতিমালা ছিল। রোহিঙ্গা সঙ্কটের আন্তর্জাতিকীকরণের বিরোধিতা করে মিয়ানমারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সমস্যা শান্তিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে হবে।

মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ সমঝোতাকে ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ বা দু’পক্ষের জন্য বিজয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এব্যাপারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তরফে কোন প্রতিক্রিয়া এখনও জানা যায়নি।

মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিন্ত কিয়াইং রয়টার্সকে বলেন, বাংলাদেশ তাদের প্রত্যাবাসনের ফরম পাঠানোর পরপরই যত শিগগিরই সম্ভব আমরা তাদেরকে ফেরত নিতে প্রস্তুত। প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ব্যক্তিগত পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্তসহ নিবন্ধন ফরম পূরণ করতে হবে বলে জানান তিনি।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।