ঘটনাটি ঘটেছে ১১ অক্টোবর। একাধিক জিডি ও মামলা হয়েছে পাল্টাপাল্টি। রিহ্যাবের সাধারণ সদস্য কামরুলের এমন ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকসহ সাধারণ সদস্যরা চরম ক্ষুব্ধ। ভর করেছে নিরাপত্তাহীনতা। আশঙ্কা আছে আরও বড় কোনো অঘটনের। এ অবস্থায় বিভক্ত দুই গ্রুপের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এক গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। অন্য গ্রুপে অপর সহসভাপতি সোহেল রানা।
দায়-দায়িত্ব নির্ধারণসহ ঘটনার কূলকিনারা করতে তদন্ত চালাচ্ছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং থানা পুলিশ। তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ, যা যুগান্তরের কাছেও এসেছে।
জানতে চাইলে শুক্রবার সকালে রিহ্যার সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘রিহ্যাবের সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে কয়েকজন পরিচালক আমাকে চিঠি দিয়েছেন। মিটিং রুমে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে হুমকি ও হেনস্তার ঘটনায় তারা বড় ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় আছেন। এ বিষয়ে এখনও কোনো সমাধানে আসতে পারিনি। বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি নসরুল হামিদ বিপুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি এখন দেশের বাইরে আছি। দেশে ফিরেই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’
রিহ্যাবের সহসভাপতি (অর্থ) সোহেল রানা বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হওয়ার পর রিহ্যাব সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া ও পরিচালক কামাল মাহমুদসহ অন্য অসৎ সদস্যদের আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। সম্প্রতি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে মিরপুরের মাটিকাটা এলাকায় প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ৬ একর জমিতে রিহ্যাবের পক্ষ থেক ১০টি বহুতল ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রিহ্যাবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই প্রকল্পে রিহ্যাব কার্যকরী পরিষদের কেউ অংশ নিতে পারবেন না। এতে রিহ্যাবের সাধারণ সদস্যদের সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু টেন্ডার চলাকালীন রিহ্যাবের তৎকালীন সিনিয়র সহসভাপতি রবিউল হক এ প্রকল্পে সুযোগ পান। তাকে সহযোগিতা করেন বর্তমান সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বিধিবহির্ভূতভাবে রিহ্যাব থেকে টাকা-পয়সা সরিয়ে নেন। আমি এসবের বিরোধিতা করায় তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।’
সোহেল রানা আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করার মিথ্য অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে ১৭ জুলাই আদালতে মামলা করা হয়। একই মামলায় রিহ্যাবের সাবেক সহসভাপতি সরদার মো. আমিনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগ আনা হয়। ধানমণ্ডি থানা আওয়ামী লীগ নেতা মোতালেব সিকদার নান্নুর দায়ের করা মামলার আরজিতে বলা হয়, আমি ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট রিহ্যাব আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করেছি। আমি যদি কটূক্তি করতাম তাহলে ওইদিন বা ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত। প্রায় ১১ মাস পরে কেন মামলা হল? অথচ ওই শোক দিবসের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলাম আমি।’
সোহেল রানা বলেন, ‘মামলাটি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন। বিচারাধীন বিষয়ে তদন্ত করতে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে লিয়াকত আলী ভূঁইয়াকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে লিয়াকত আলী ভূঁইয়া আমাকে লিখিত চিঠি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১১ অক্টোবর বিকালে রিহ্যাব কার্যালয়ের বোর্ড মিটিং রুমে তদন্ত কমিটির সামনে বক্তব্য দিচ্ছিলাম। এ সময় রিহ্যাব সহসভাপতি ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক লিয়াকত আলী ভূঁইয়ার কাছে একটি ফোন আসে। লিয়াকত আলী ভূঁইয়া কল রিসিভ করে ‘আস’ বলেই ফোনটি কেটে দেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বোর্ড মিটিং রুমের ওয়েটিং রুমে চিৎকার-চেঁচামেচি ও গালিগালাজের শব্দ শুনতে পাই। পরে জানতে পারি, আমার জন্য অপেক্ষমাণ রিহ্যাব সদস্য শামীম আহমেদকে রিহ্যাব পরিচালক কামাল মাহমুদ এবং কলাবাগান থানা যুবলীগ আহ্বায়ক কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০-১৫ জনের একটি বহিরাগত সন্ত্রাসী দল চড়-থাপ্পড় মারে। তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি শোনার পর আমি এবং রিহ্যাব পরিচালক মহিউদ্দিন শিকদার ওয়েটিং রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার কাছে যাই। তখন কামরুল ইসলাম ও কামাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী দলটি জোর করে মিটিং রুমে ঢুকে পড়ে। তারা আমাকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করতে করতে রিহ্যাব সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়ার সামনে নিয়ে যায়। এ সময় যুবলীগ নেতা কামরুল ইসলাম অস্ত্র উঁচিয়ে আমাকে জিম্মি করে। তখন কামরুলের উদ্দেশে রিহ্যাবের পরিচালক কামাল মাহমুদ বলেন, ‘কামরুল গুলি কর।’ তখন রিহ্যাব পরিচালক মহিউদ্দিন শিকদার আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে কামরুল ইসলাম তার (মহিউদ্দিন) দিকে অস্ত্র তাক করে হত্যার হুমকি দেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১১ অক্টোবরের ঘটনায় রিহ্যাব সহসভাপতি সোহেল রানা বাদী হয়ে ১৫ অক্টোবর আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় রিহ্যাব সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া, পরিচালক কামাল মাহমুদ এবং যুবলীগ কলাবাগান থানার আহ্বায়ক ও রিহ্যাব সদস্য কামরুল ইসলামকে আসামি করা হয়। মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয় পিবিআইকে। তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক হারুন-অর-রশিদ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে জানান, ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সাতজন সাক্ষীর মধ্যে একজনের বক্তব্য নেয়া হয়েছে। শনিবার আরও ছয়জনের বক্তব্য নেয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে ২৪ অক্টোবর রিহ্যাব সহসভাপতি সোহেল রানা ও রিহ্যাব সদস্য শামীম আহমেদের বিরুদ্ধে কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রিহ্যাব পরিচালক কামাল মাহমুদ। জিডিতে প্রাণনাশের হুমকির আশঙ্কা করা হয়েছে। এ জিডির তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার এসআই মনজুর হোসেন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে জানান, ঘটনার এক মাসেও প্রাণনাশের হুমকি দেয়া সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে মৌখিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। তদন্ত শেষ করতে আরও প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগবে উল্লেখ করে বলেন, পূর্বশত্রুতার জেরেই এ জিডিটি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে ১১ অক্টোবরের ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে রিহ্যাবের ১০ পরিচালক ১৭ অক্টোবর রিহ্যাব সভাপতির কাছে লিখিত আবেদন জানান। ওই আবেদনে বলা হয়, ‘বোর্ড মিটিং রুমে সোহেল রানা বক্তব্য দেয়ার সময় রিহ্যাব সহসভাপতি ও তদন্ত কমিটির প্রধান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মোবাইলে কথা বলছিলেন। তিনি কথা বলা শেষ করলে হঠাৎ বাইরে উচ্চস্বরে শব্দ শোনা যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে রিহ্যাব পরিচালক নাইমুল হাসান তাৎক্ষণিকভাবে রোর্ডরুমের বাইরে যান। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে রিহ্যাব পরিচালক কামাল মাহমুদ ও যুবলীগ নেতা রিহ্যাব সদস্য কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে বহিরাগতরা গালিগালাজ করতে করতে বোর্ডরুমে প্রবেশ করে। তারা অস্ত্র ঠেকিয়ে শার্টের কলার ধরে সহসভাপতি সোহেল রানাকে বোর্ডরুমের বাইরে নিয়ে যায়। পরিচালক মহিউদ্দিন সিকদার বহিরাগতদের থামাতে গেলে তাকেও গুলি করার হুমকি দেয়া হয়। উপস্থিত সব পরিচালককেই একই ধরনের হুমকি দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সভার সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়াকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি কোনো কর্ণপাত করেননি। এ সময় পরিচালক কামাল মাহমুদ টেবিল চাপড়াতে চাপড়াতে আরেক পরিচালক এমএম হাফিজ আল আসাদকে ধমকাতে থাকেন। পরে অপমানিত ও অসহায়ত্ব বোধ করে পরিচালকরা রিহ্যাব অফিস ত্যাগ করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রিহ্যাব অফিসে যে কোনো সভায় অংশগ্রহণ করা পরিচালকদের জন্য প্রাণনাশের হুমকিস্বরূপ বলে রিহ্যাব সভাপতিকে দেয়া চিঠিতে পরিচালকরা উল্লেখ করেন।
জানতে চাইলে রিহ্যাব সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া জানান, সবগুলো বিষয় নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রিহ্যাব সহসভাপতি রবিউল হক কীভাবে মিরপুরের পিপিপি প্রকল্পে কাজ পেয়েছে তা আমার জানা নেই। এটা সরকারের বিষয়।’ তিনি জানান, কেউ চাইলেই রিহ্যাব থেকে টাকা সরিয়ে ফেলতে পারে না। টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে রিহ্যাবের নিজস্ব নীতিমালা আছে।
যুবলীগ নেতা ও রিহ্যাব সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, ১১ অক্টোবর সোহেল রানা আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দিতে তার সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদকে নিয়ে এসেছিলেন। এ নিয়ে সামান্য ঝামেলা হয়েছিল। এটা বড় কোনো ঘটনা নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। এটা স্বাভাবিক। তাই আমাদের বিরুদ্ধে সোহেলের সব অভিযোগ সত্য নয়।’
রিহ্যাব পরিচালক কামাল মাহমুদ বলেন, ‘ঘটনার দিন বোর্ড মিটিং সভায় কামরুল ইসলাম তার নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। এটা তেমন দোষের কিছু নয়। অস্ত্র তাক করার দৃশ্যটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়েছে। তাই এ নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা ও রিহ্যাব সদস্য শামীম আহমেদ জানান, ‘রিহ্যাবের একজন সদস্য হিসেবে আমি ওই অফিসে যেতেই পারি। অনুমতি না থাকায় সোহেল রানা বক্তব্য দেয়ার সময় আমি মিটিংয়ে প্রবেশ করিনি। আমি বাইরে ওয়েটিংরুমে অবস্থান করছিলাম। এ সময় সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়ার ক্যাডার ও যুবলীগ নেতা কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়।’ যুগান্তর