ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে বেজে উঠেছে ‘অশনিসংকেত’। অর্থনীতির চালিকাশক্তির মূল নিয়ামক এই ব্যাংকিং খাতে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে খেলাপি ঋণ। খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
তাদের মতে, ঋণের নামে গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত লুটে নিচ্ছে খেলাপিরা। এ ক্ষেত্রে আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের পক্ষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। কারণ ‘অবলোপন’-এর দোহাই দিয়ে ঋণের তালিকা থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে খেলাপিদের নাম।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গ্রাহকের টাকা আমানত হিসেবে রেখে ব্যাংকগুলো ব্যবসা করছে। অথচ এ আমানতের টাকায় ভুয়া এলসি খুলে এবং বিভিন্ন কৌশলে বিদেশে অর্থ পাচার করছে একটি চক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ ও হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার করা হচ্ছে। ফলে আমানতকারীর অর্থ একদিকে খেলাপিরা লুটপাট করছে, অন্যদিকে হচ্ছে বিদেশে পাচার।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রভিশন (খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ও মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। এতে অনেক ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনছে। আবার আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে তারল্য সংকটে ভুগছে কয়েকটি ব্যাংক। এ ছাড়া নতুন করে যোগ হতে যাচ্ছে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন (প্রস্তাবিত)। এটি কার্যকর হলে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েম হবে বলেও মন্তব্য তাদের।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত এ আইনে একই পরিবারের চারজনকে ব্যাংক পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে। আগে একই পরিবার থেকে ২ জনের কোটা ছিল। পাশাপাশি ৩ বছর থেকে তাদের মেয়াদ বাড়িয়ে নয় বছর করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এ সিদ্ধান্ত অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, এ সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ দুর্বল হয়ে পড়বে। নামে-বেনামে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে। এতে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে আরও খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতে নেমে আসবে মহাবিপর্যয়। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অবলোপন ছাড়া মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ৬৫ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। মন্দ ঋণের বড় অংশ অবলোপনের তালিকায় উঠে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
আরও জানা গেছে, উল্লিখিত মন্দ ঋণ আগামী পাঁচ বছর পর্যবেক্ষণে রাখবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। এ সময়ে খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায়ে ব্যর্থ হলে প্রথমে এ ব্যাপারে একটি মামলা করবে কর্তৃপক্ষ। এরপর ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রেখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মূল খাতা থেকে ওই ঋণ বাদ দেয়া হবে। যেটি অবলোপন হিসেবে পরিচিত।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, অবলোপনকৃত অর্থের পুরোটাই গ্রাহকের আমানত। এই অবলোপন অর্থের প্রকৃত তথ্য গোপন করছে ব্যাংকগুলো। কারণ বর্তমান ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে বলে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তা সঠিক নয়। প্রকৃত এ অর্থের পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকার কম নয়। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৫ শতাংশের বেশি অবলোপনের টাকা আদায়ের নজির নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া ছাড়াও ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কম থাকার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করায় সেখানেও বেড়ে গেছে খেলাপির সংখ্যা।
খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মশালায় তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। তবে খেলাপি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এটি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি ৭ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকেরই ঘাটতি ৭ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে বেসরকারি খাতের চার ব্যাংকের।
আরও জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক এবং একটি বেসরকারি ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব ব্যাংক ঋণের মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় পুরো হোঁচট খেয়েছে। এতে ব্যাংকগুলো নিজের মূলধন তো হারিয়েছেই, উপরন্তু ১৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। জানা গেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার পর থেকে এমন দশা হয়েছে। এর আগে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি এতটা প্রকট ছিল না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খেলাপি ছাড়াও পরিচালকরা নিজের ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার মাধ্যমে এক ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকেও একই ঘটনা ঘটছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণ করা হয় ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ব্যাংক মালিকরা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। নতুন-পুরনো মিলিয়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৬টিই ব্যাংক পরিচালকদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি ব্যাংকের পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে ৯টি ব্যাংকের পরিচালক গ্যারান্টার বা জিম্মাদার হয়ে ঋণ দিয়েছেন আরও ২৩১ কোটি টাকা। সংশোধিত আইন কার্যকর করা হলে পরিবারতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে পরিচালকদের লুটপাটের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের ফলে ব্যাংকগুলোর ওপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। এটি হবে ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের পরিপন্থী। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। এটি আশঙ্কাজনক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এ সিদ্ধান্ত ব্যাংক সুশাসনের জন্য মোটেও ঠিক হয়নি। এর কোনো যৌক্তিকতাও নেই। সুশাসনের অভাবসহ সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বর্তমান ব্যাংকিং খাত। এখানে পুরোপুরি সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। অথচ এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দুর্বলতার পাশাপাশি সরকারের এ ব্যাপারে সদিচ্ছার অভাব আছে। এর ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সে কারণে খেলাপি ঋণ না কমে শুধু বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া যাচাই-বাছাই ছাড়া যেসব নতুন ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলোও খেলাপিতে যোগ হচ্ছে। তিনি বলেন, ঋণ অবলোপনের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক হলেও এতে কিছুটা খারাপ বার্তা আছে। কারণ অনেকে মনে করেন, ঋণ অবলোপন করলে সে টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। তার প্রমাণ হচ্ছে- অবলোপন থেকে আদায়ের পরিমাণ খুবই কম। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। সে ঋণগুলো আবার খেলাপি হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে ভালো ব্যবসায়ীও খেলাপি হচ্ছেন। অবশ্য তার জন্য ব্যবসার পরিবেশ না থাকাকে দায়ী করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন অনেক ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালক এলে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হবে। এটি বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতির দর্শনের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। কারণ বঙ্গবন্ধু কল্যাণ অর্থনীতির কথা বলে গেছেন। এই তাৎপর্য হচ্ছে ক্ষমতা বা অর্থ একহাতে কেন্দ্রীভূত হবে না, কয়েকটি হাতে ছড়িয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তা হবে না। কারণ একটি পরিবার একটি ব্যাংককে মোটামুটি দখলে রাখবে। এতে আমানতকারীদের টাকা-পয়সা খেয়ানতের সম্ভাবনা থাকবে। এর প্রমাণ ন্যাশনাল ব্যাংক। আইন অমান্য করে ওই ব্যাংকের বোর্ডে একই পরিবারের ৫ জন সদস্য আছেন। এর ফলাফল হচ্ছে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় পড়ে গেছে ব্যাংকটি। গত তিন বছরে তিনজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এবং গত নয় মাসে সেখানে কোনো এমডি যোগদানে ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। এর অর্থ হচ্ছে এটি একটি ব্যক্তি ও পরিবারতান্ত্রিক ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা যেন এটি দেখেন বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতির সঙ্গে কতটা মেলে। তিনি আরও বলেন, খেলাপির সাগরে ভাসছে ব্যাংকিং খাত।
বিগত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ দেয়া সব এমডি-পরিচালনা পর্ষদ দুর্নীতিবাজ ছিল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা ঋণ দিয়েছিল। সেসব ঋণ বর্তমানে খেলাপি হয়ে গেছে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের চারজন এবং টানা ৯ বছর থাকার বিধান যদি চালু হয় তবে ব্যাংকিং খাত শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।যুগান্তর