বিবিসি : ভারতে বহুল আলোচিত আখিলা হাদিয়ার তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’ মামলায় দেশের সুপ্রিম কোর্ট সোমবার তার বাবা-মা বা স্বামী, কারো কাছেই তাকে থাকার অনুমতি না-দিয়ে আপাতত তার মেডিক্যাল কলেজের হাতেই তার অভিভাবকত্ব তুলে দিয়েছে। আগামী ১১ মাস তিনি তামিলনাডুর একটি কলেজে তার ইন্টার্নশিপ শেষ করবে এবং সে সময় কলেজের ডিন-ই তার অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবেন বলে শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছে।
এর আগে হাদিয়া নিজে কোর্টে বাবা-মার ‘অন্যায় হেফাজত’ থেকে মুক্তির জন্য আকুল আবেদন জানালে বিচারপতিরা তা কিছুটা মেনে নেন, কিন্তু তাকে তার মুসলিম স্বামীর ঘর করারও অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এই মামলায় পরবর্তী শুনানি হবে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে। সারা ভারতে কথিত ‘লাভ জিহাদ’ বিতর্কের প্রায় আইকনে পরিণত হওয়া কেরালার পঁচিশ বছরের মেয়ে আখিলা হাদিয়া সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সামনে কী বলেন, সে দিকে নজর ছিল প্রায় গোটা দেশের।
এবং সোমবার বিকেলে দেশের সর্বোচ্চ এজলাসে দাঁড়িয়েও তিনি সে কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন, যা তিনি দু’দিন আগে দিল্লি আসার সময় কোচি এয়ারপোর্টে সাংবাদিকদের উদ্দেশে চিৎকার করে জানাতে চেয়েছিলেন। তুমুল গ-গোলের মধ্যেই হাদিয়া সেদিন বলেছিলেন, কেউ তাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য জোর করেনি, তিনি স্বেচ্ছায় মুসলিম হয়েছেন ও শাফিন জাহানকে বিয়ে করেছেন।
এজলাসে দাঁড়িয়ে কালো হিজাবে মুখ ঢেকে তিনি বিচারপতিদের বলেন, তিনি নিজের সেই ধর্মবিশ্বাসেই অটল থাকতে চান ও বাবা-মার অন্যায় হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বামীর অভিভাবকত্বে নিজের ডাক্তারি পড়াশুনো শেষ করতে চান।
সুপ্রিম কোর্ট এই অনুরোধ কিছুটা মেনে নিয়ে তাকে পরবর্তী ১১ মাস মেডিক্যাল ইন্টার্নশিপ শেষ করার সম্মতি দিয়েছে – কিন্তু পাশাপাশি এটাও জানিয়েছে এই সময় তার বাবা-মা বা স্বামী কেউই নন, বরং মেডিক্যাল কলেজের ডিনই তার অভিভাবক থাকবেন।
বিচারপতিদের প্রশ্নের উত্তরে হাদিয়া বারবার বলেন, তার একমাত্র চাওয়া হল ‘মুক্তি’। কিন্তু তার বাবার আইনজীবী শুনানিতে যুক্তি দিয়েছেন হাদিয়ার এমনভাবে মগজধোলাই করা হয়েছে যে এখন তার কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই।
আইনজীবী এ রঘুনাথ জানান, ‘আমাদের প্রধান বক্তব্যই হল হাদিয়ার মাথায় পরিকল্পিতভাবে নানা জিনিসপত্র ঢোকানো হয়েছে – এবং সে আসলে একটা মানসিক অপহরণের শিকার। এই মানসিক পরিস্থিতিতে সে কোর্টে দাঁড়িয়ে কী বলল বা কী সাক্ষ্য দিল তার খুব একটা মূল্য নেই, আর তাতে গুরুত্ব দেওয়ার কোনও দরকার নেই।’
কিন্তু হাদিয়ার স্বামী শাফিন জাহানের হয়ে যিনি সওয়াল করেন, সেই সিনিয়র আইনজীবী কপিল সিবালের বক্তব্য ছিল, হাদিয়া মানসিকভাবে সুস্থ কি না সেটা তার সঙ্গে কথা বলার পরই বিচারপতিদের স্থির করা উচিত। এমন কী, ভারতের যে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি এই গোটা ঘটনার তদন্ত করেছে তাদের রিপোর্টের চেয়ে হাদিয়ার কথার গুরুত্ব অনেক বেশি বলেও যুক্তি দেন সিবাল।
হাদিয়ার হয়ে কেস প্রস্তুত করতে যিনি সাহায্য করেছেন কেরালার অ্যাক্টিভিস্ট সেই বর্ষা বসির বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে পাঁচ মাস নিজের বাবা-মার হেফাজতে ও কেরালা পুলিশের সুরক্ষায় থাকার পর বেরিয়ে এসে প্রথম সুযোগেই সে জানিয়েছে সে স্বেচ্ছায় মুসলিম হয়েছে এবং শাফিন জাহানই তার স্বামী। তার এই বক্তব্যকে সুপ্রিম কোর্টের মেনে নেওয়া উচিত, কারণ এটা তার সাংবিধানিক অধিকার।’
কিন্তু বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি জাস্টিস খানউইলকর শুনানিতে মন্তব্য করেন, এটি একটি অস্বাভাবিক মামলা এবং হাদিয়ার কথা শুনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, বিষয়টা অত সরল নয়। দেশের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রও বলেন, তার জীবনে এত জটিল মামলা তিনি আর দেখেননি।
এদিকে ভারতে শাসক দল বিজেপিও মনে করছে, লাভ জিহাদ ভারতে একটা বাস্তবতা। আরএসএস তথা বিজেপির প্রভাবশালী নেতা রাম মাধব সোমবার বলেছেন, ‘কেরালাসহ দেশের নানা প্রান্তে এতগুলো ঘটনার কথা এখন সামনে এসেছে যে সুপ্রিম কোর্টেরও এখন নীরব থাকা সাজে না।’
তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন আখিলা হাদিয়ার ঘটনায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত কার্যত একটা মধ্যপন্থাই বেছে নিয়েছে। হাদিয়াকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা কোনো মন্তব্য করেননি ঠিকই, তবে বাবা-মার হেফাজত থেকেও প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী হাদিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।