নগরের জাদুকর আনিসুল হক

মুনসুর রহমান : চিরকাল পরিচ্ছন্ন থাকাটা একজন মানুষের পক্ষে খুব দুরূহ। কিন্তু তাকে কখনোই অপরিচ্ছন্ন দেখা যায়নি। আর এ জন্যই হয়তো সার্বক্ষণিক কর্মধারার প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তিরও কোনো কমতি ছিল না তার মধ্যে। মেধা ও পরিশ্রমের সঙ্গে এক অসাধারণ যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল তার কর্মক্ষেত্রে, যে যোগসূত্র দিয়ে তিনি সব কর্মকান্ডের স্রোতধারাকেই বেগবান করেছিলেন। তিনি হলেন নগরের জাদুকর নামে খ্যাত সদ্য প্রয়াত আনিসুল হক।

তিনি একাধারে টিভি উপস্থাপকের গন্ডি পেরিয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত গার্মেন্ট সেক্টরেও মোহাম্মাদি গ্রুপের হাত ধরে বিশেষ অবস্থান করে নেন তিনি। এবং জড়িত ছিলেন রিয়েল এস্টেট, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিদ্যুৎ খাতেও। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নাগরিক টিভির কর্ণধারও তিনি। তিনি দুই বছর আগে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনীতিতে আসেন। আর পরিচ্ছন্ন, সবুজ, আলোকিত ও মানবিক ঢাকা গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে প্রথম মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর সচেষ্ট হন ঢাকাকে বদলে দেয়ার অঙ্গীকারে। তার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন ছিল ঢাকাকে আধুনিক সিটি হিসাবে গড়ে তুলবার। তাই মানুষকে সংঘবদ্ধ করে রূপকথার জাদুর মতোই পাল্টে দেওয়ার চেষ্ঠা করেছেন আমৃত্যু।

মাত্র ৩০ মাস ঢাকা উত্তরের সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে সময় পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হিসাব করলে তিনি মাত্র ২৫ মাস অর্থাৎ খুব বেশি দিন মানুষের পাশে থেকে কাজ করার সুযোগ পায়নি, তবে অল্প দিনেই ঢাকা উত্তরকে ঢেলে সাজিয়েছে। ‘ক্লিন ঢাকা, গ্রিন ঢাকা’ শুধু তাঁর স্লোগানই ছিল না, করেও দেখিয়েছে। এমনকি রাস্তাার পাশে প্রশস্ত ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজগুলোতে ফুলের টব, বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোকে মনোরমভাবে সাজানো, কী করেনি সে। সাতরাস্তার ট্রাকস্ট্যান্ড উঠিয়ে মানুষ চলাচলের যোগ্য করেছিলেন, ‘ঢাকার চাকা’ নামে গুলশান এলাকায় গাড়ি চালু করেছিলেন, লেকের পাড় দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি থেকে শুরু করে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার, এমনকি ফুটপাত থেকে শুরু করে সড়ক বিভাজক, গলিপথ থেকে ওভারব্রিজ সর্বত্রই রয়েছে তাঁর দায়িত্ববোধের স্বাক্ষর।

নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি নান্দনিক দিকটিতেও ছিল তাঁর শিল্পিত রুচিবোধের প্রতিফলন। তিনি মশামুক্ত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ, স্মার্ট কার্ড প্রদান, ফরমালিনমুক্ত ও নিরাপদ বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, মাদক ও সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ, সড়কগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা, স্কুলে হেলথ প্রোগ্রাম চালু, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য মিডিয়া সেন্টার করাসহ বিভিন্ন স্বপ্ন নগরবাসীকে দেখান।

নগরের জাদুকরের আনিসুল হক জন্মগ্রহণ করেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কবিরহাট গ্রামে ১৯৫২ সালে। তবে তার শৈশবের একটি বড় সময় ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে নানার বাড়িতে কেটেছিল । তার বাবা নাম শরীফুল হক ও মায়ের নাম রওশন আরা হক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন আনিসুল হক। আশির দশকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের বিকাশের পর্বে এর সঙ্গে জড়ান তিনি। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন আনিসুল হক। তৈরি পোশাক ছাড়াও এ গ্রুপের রয়েছে বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা। ‘ডিজিযাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড’ ও ‘নাগরিক টেলিভিশনের’ মালিকানাও তার ব্যবসায়ী গ্রুপের। গত শতাব্দীর আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার উপস্থাপনায় ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ অনুষ্ঠান দুটি পায় তুমুল জনপ্রিয়তা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিটিভিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে নিজের ব্যবসার দিকে আর তাকাননি আনিসুল হক। পরিবারের বাকি সদস্যদের হাতে মোহাম্মদী গ্রুপের দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজে ব্যস্ত থেকেছেন ঢাকা গড়ার কাজে। আর একজন সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা হিসাবে জ্বালানি খাত, তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যম খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রসমূহের মালিকদের সংস্থা) প্রেসিডেন্ট ছিলেন আনিসুল হক। এবং পোশাক মালিকদের সংগঠন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি (২০০৫-০৬)। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বিনা শুল্কে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের পথ সুগম করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ইউরোপে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের জন্য তিনি জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি (২০০৮-১০)। সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কাজ সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ গতিশীল রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানুষে মানুষে মেলবন্ধন সৃষ্টি। ২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এই সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আনিসুল হক। কিন্তু তিনি তার অপূর্ণ স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়ন না করে চিরদিনের মতো আমোদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেন।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।