ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে জোটের রাজনীতি ততটাই স্থবির হয়ে পড়ছে। অথচ এ সময় জোটভুক্ত দলগুলোর গুরুত্ব বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে উল্টো ঘটনা ঘটছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। কিছু ঘরোয়া সভা, ইস্যুভিত্তিক বিবৃতির মধ্যেই তারা আটকে আছে। মাঠে তাদের কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই।
অন্যদিকে দেশের বড় দুই জোটের পাশাপাশি তৃতীয় জোট গঠনের উদ্যোগও থমকে গেছে। অনেক দিন ধরেই বড় দুই দলের বিপরীতে তৃতীয় জোট গঠনের একটা প্রক্রিয়া চলছিল। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় অনেক নেতা বৈঠকও করেন। কিন্তু জোটের নেতৃত্ব কে দেবেন তা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ জোটভুক্ত বিভিন্ন দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তারা বলেন, জোটের প্রধান দলের অনেক নেতা শরিকদের প্রতি অবহেলা দেখান বলে অভিযোগ আছে। যে কারণে অনেক কর্মসূচিতে জোটভুক্ত দলগুলোর নেতারা মাঠে নামেন না। রাগ-ক্ষোভ-অভিমানে তারা মুখ ফিরিয়ে রাখেন। ফলে তাদের উপস্থিতি শুধু কাগজে-কলমে।
এছাড়া শরিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জোটের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আদর্শগত মতপার্থক্যও বিদ্যমান। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের রাজনীতিতে স্থবিরতার পাশাপাশি শুরু হয়েছে অস্থিরতা। জোটভুক্ত ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব। ভবিষ্যৎ লাভের আশায় অনেক দল বর্তমান জোট ছেড়ে অন্য জোটে যোগ দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। ফলে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ স্বার্থের কারণে বারবার ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে ছোট ছোট দলে।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জোটের রাজনীতিতে বড় দলগুলোর মধ্যে ছোট দলগুলো হারিয়ে যায়। তাদের স্বাতন্ত্র্য, নীতি-আদর্শ সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়। তাই জোটের রাজনীতি ছোট দলগুলোর জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বার্থের কারণে জোটগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। জোটের মাধ্যমে কিছু দল কিছু লোককে বাঁচিয়ে রাখে। যেসব দলের ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোর বিকশিত বাধাগ্রস্ত হয়। জোটের রাজনীতি দেশের গণতন্ত্র বিকাশ ও জনস্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না।
১৪ দলীয় জোট : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট প্রায় স্থবির। নিজেদের আন্তঃবৈঠক ছাড়া জোটগত কোনো কর্মসূচি নেই। এমনকি এর আগে দুটি সংখ্যালঘু হামলার ঘটনায় জোটগতভাবে পরিদর্শনে যাওয়া হলেও সর্বশেষ রংপুরের ঘটনায় সেটাও হয়নি। তবে এর আগে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জোটের নেতাদের একত্রে বসতে দেখা গেছে।
এদিকে থমকে আছে জোট সম্প্রসারণের উদ্যোগও। একাধিকবার জোটের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। প্রথম দফায় জোটের বাইরে থাকা অন্যান্য প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। দ্বিতীয় দফায় তৃণমূল বিএনপি ও ইসলামিক ফ্রন্টকে জোটের শরিক করার উদ্যোগ নেয়া হলেও কৌশলগত জটিলতায় তা ভেস্তে যায়।
১৪ দলীয় জোটের শরিক হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতাও খুব একটা নেই। ১৪ দলের ব্যানারে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নেয়া হলেও এসব কর্মসূচিতে ছোট শরিক দলগুলোর তেমন অংশগ্রহণ চোখে পড়ে না।
নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারে জোটের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূল অংশীদার আওয়ামী লীগ। তাদের পক্ষ থেকে জোট সক্রিয় করার উদ্যোগ না নিলে অন্যরা তো এ বিষয়ে কিছু করতে পারে না। এছাড়া বিরোধী পক্ষ রাজনৈতিক ইস্যুতে মাঠে নামলে তখনই কেবল ১৪ দলের প্রয়োজন অনুভব হয় এবং সাময়িক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়।
জোটের একাধিক নেতা বলেন, ১৪ দলীয় জোটে আদর্শগত দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয়েছে, যা স্থবিরতার অন্যতম কারণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ইস্যুকে সামনে রেখে গঠন করা হয় এ জোট। কিন্তু কয়েকটি ইসলামী দলও এখন জোটের শরিক হয়েছে। ফলে যে আদর্শ থেকে এ জোট গঠন করা হয়েছিল এখন কিছু দলের কারণে সেই লক্ষ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আবার শরিকদের মধ্যে দু-একটি দলের নেতার দল ছাড়ার ঘটনাও ঘটেছে। ১৪ দলের থাকা, না থাকার বিতর্কে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিন দফায় নেতাকর্মীরা বেরিয়ে গেছেন। সাম্যবাদী দল ছেড়েছেন একাধিক নেতা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জোটের শরিফ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা জোটের স্থবিরতার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ১৪ দলের সক্রিয়তার বিকল্প নেই, এর ব্যাপ্তির প্রয়োজন পড়বেই, যারা এটা অস্বীকার করেন, তারা বুঝতে পারছেন না।
তিনি বলেন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর ৮০-র সঙ্গে ২০ মিলে ১০০ হয় এমন তত্ত্বে একমত নই। রাজনীতিতে এক আর এক মিলে শুধু দুই হবে এমন কথা নেই, তিন বা তার বেশিও হতে পারে। তিনি বলেন, ওয়ার্কার্স পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। পার্টি জোটভুক্ত হওয়ায় দল ও জোট দুই-ই শক্তিশালী হয়েছে।
২০ দলীয় জোট : বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীরব জোটের নেতারা বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলেন, সম্প্রতি সরকার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু এর প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোটকে কোনো কর্মসূচি নিতে দেখা যায়নি। ঘরোয়া কিছু কর্মসূচি আরও বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে জোটের ছোট ছোট দলের মধ্যে চলছে অস্থিরতা। কয়েকদিন আগে লেবার পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সম্প্রতি ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে লেবার পার্টির কোনো অংশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এর আগে জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। আবদুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বে একটি অংশ জোট থেকে বেরিয়ে যায়। কয়েক বছর আগে জোটের অপর শরিক এনপিপি ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি অংশ জোট ছেড়ে গেছে। এ সময় এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বে ১০টি দল একত্রিত হয়ে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে। নীলু মারা যাওয়ার পর ওই জোটের বাস্তবে কোনো কার্যক্রম নেই।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যেখানে রাজনীতি ও নতুন পার্টি করার অধিকার সবারই আছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বহিষ্কৃত একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করলেও এতে তাদের কাজে কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে না। কারও জন্য কোনো কিছু বসে থাকে না। তিনি দাবি করেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ আছে, থাকবে।
শরিক দল এনপিপির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, জোটের মধ্যে স্থবিরতা এটা বলা যাবে না। কয়েকদিন আগেও শরিকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন জোটনেত্রী খালেদা জিয়া। সেখানে জোটের ঐক্য ও কার্যক্রম আরও জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক ইস্যুতে বর্তমানে হয়তো রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে আমাদের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
থমকে আছে তৃতীয় জোট গঠনের প্রক্রিয়া : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প জোট গঠনের তৎপরতাও অনেকটা থমকে আছে। তৃতীয় জোট গঠনের প্রক্রিয়া বৈঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, মূল সমস্যা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হচ্ছে না। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে গণফোরাম ও জেএসডি বেশ কিছু বামদল ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করলেও সে প্রক্রিয়া বেশিদূর এগোয়নি। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন বছরে এ প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন নেতারা।
আগস্টে জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রবের বাসায় এবং সেগুনবাগিচায় একটি রেস্তোরাঁয় পৃথক দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে গণফোরাম, বাসদ, নাগরিক ঐক্য ছাড়াও কয়েকটি বামদলের প্রতিনিধি এবং কয়েকজন বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসা ও চেম্বারে জোট গঠন নিয়ে তারা আলোচনায় বসেন। এসব বৈঠকে দুই জোটের বাইরে আলাদা জোট গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও কোন প্রক্রিয়ায় বা কারা থাকবেন সেই জোটে এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তারা।
জানতে চাইলে জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, মানুষ দুই জোটের বাইরে তৃতীয় শক্তি চায়। তৃতীয় শক্তির লক্ষ্য নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। জোট গঠনের কাজ থমকে আছে এমনটা বলা যাবে না। এ নিয়ে আজ আমার বাসায় আবারও বৈঠক হবে। আশা করি শিগগিরই আমরা একটা ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব। যুগান্তর