মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের পঞ্চম দিন আজ মঙ্গলবার

সাদেকুর রহমান : মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের পঞ্চম দিন আজ মঙ্গলবার। একাত্তরের এই দিনে সীমান্ত লাগোয়া এলাকাসহ বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রচন্ড লড়াই। স্থলে মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনী ও দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকহানাদার বাহিনী। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আর কখনো পড়েনি তারা। দিনটি তাদের জন্য আসন্ন চরম বিপর্যয়ের বার্তাই বয়ে এনেছিল। এমনকি মিত্র  দেশগুলো শক্তিধর হলেও পাকিস্তান সরকারের সকল তৎপরতা বিফলে গেছে। এদিন পাকিস্তান রক্ষায় বঙ্গোপসাগরে কেউ কোনো নৌ-জাহাজ পাঠালে তারাও ভারতের আক্রমণের শিকার হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
এদিনে ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো সারা দিন ধরে অবাধে আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়, অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো। ভারতীয় বিমানবাহিনীর হিসাবমতে, ১২ ঘন্টায় ২৩২ বারে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে ৫০ টনের মতো বোমা ফেলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গী বিমান আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যবোঝাই কয়েকটি লঞ্চ এবং স্টীমার ধ্বংস হয়। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে ধ্বংস হয় পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘গাজী’। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার নিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ে এটি একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপারগতা প্রকাশ করে। এতে দুটি কাজ হলো-১. বিশ্বের সব দেশ বুঝলো বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার কোন ক্ষমতা আর পাকিস্তানী বাহিনীর নেই; এবং ২. ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দরকে ঘায়েল করার সুযোগ পেলো।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বরের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয় এভাবে, “পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। বাংলার আকাশ সম্পূর্ণ শত্রু কবলমুক্ত। ভারতীয় নৌবাহিনী নিরপেক্ষ দেশের জাহাজকে সতর্ক করে দেয়। যাতে তারা চট্টগ্রাম থেকে সরে যায়। পাক স্থলবাহিনীর পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। যশোরের সঙ্গে রাজশাহী ও নাটোরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। ঢাকার সঙ্গে যশোর এবং খুলনার যোগাযোগ তখনও টিকে আছে। লাকসাম এবং ঝিনাইদহে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড লড়াই হলো এবং হানাদার বাহিনী পিছু হটে গেলো। নিয়াজীর মাথায় তখন অন্য ভাবনা। বিপর্যয়ের খবরে দিশেহারা, তিনি সকলকে আদেশ দিলেন যাতে তারা ঢাকায় চলে আসে।”
কবি আসাদ চৌধুরী এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে আরো বলেন, “দেশ থেকে এবার বিদেশে। খোদ জাতিসংঘে। নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়, তাকে সমর্থন জানায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। ফ্রান্স এবং বৃটেন ভোট দানে বিরত থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে সে যাত্রা সামাল দিলো। পাকিস্তান যখন হেরে যাচ্ছে সে সময় যুদ্ধবিরতি মানা হলে মিত্রবাহিনী যে সাফল্য অর্জন করেছিল তাও হারাতে হতো।”
আরেক লেখক আহমাদ মাযহার তার ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “সর্বক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় পাকিস্তানি সেনাপতি জেনারেল নিয়াজী সমস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ৫ ডিসেম্বর ঢাকার কাছাকাছি পদ্মা-মেঘনার নিকটবর্তী অঞ্চলে চলে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় এবং ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ প্রচন্ড আক্রমণের কারণে তা কার্যকর করতে পারেনি পাকবাহিনী।”
ওই সময়ের পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এদিন জাতিসংঘে উত্থাপিত যুদ্ধ বন্ধের মার্কিন প্রস্তাবে চীনা প্রতিনিধি মি. হুয়াং হুয়া জোর সমর্থন দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলার তীব্র নিন্দা করা উচিত। তিনি পাকিস্তান থেকে অবিলম্বে বিনা শর্তে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। চীনা প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, সোভিয়েত সামাজিক সা¤্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ভারত আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে।
প্রামাণ্য দলিলাদি অনুযায়ী, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান এদিন এক ঘোষণায় অবসরপ্রাপ্ত ৫৫ বছরের কম বয়সী মেজর পর্যন্ত সকল সৈনিককে নিকটস্থ রিক্রুটিং অফিসে হাজির হওয়ার জন্য পুনরায় নির্দেশ দেন। ভারতীয় হামলার অভিযোগ তুলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পুতুল শাসক গবর্নর ডা. মালিক প্রতিরক্ষা তহবিল গঠন করে সেখানে মুক্ত হস্তে দান করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন পুনরায়। এত কিছুর পরও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান বিমানবাহিনী এদিন দুপুরের মধ্যেই চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এদিনের পর ঢাকার আকাশে আর কোনো পাক জঙ্গি বিমান ওড়েনি। তেজগাঁও বিমানবন্দর রানওয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয় টনকে টন বোমা ফেলে। দুই দিন ধরে ঢাকার আকাশে প্রতি মুহূর্তে বিমানের আনাগোনায় ঢাকাবাসীর চোখ ছিল আকাশের দিকে। বিভিন্ন এলাকায় মিত্রবাহিনীর বিমান দুই শতাধিকবার হানা দেয়। অবশেষে ঢাকার আকাশ বাংলাদেশ এবং ভারতের বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর একদিন পরেই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
স্থলভাগেও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ঘাঁটিতে হানাদার বাহিনী পরাজিত হতে থাকে। ভারতীয় বাহিনী প্রধান সড়কগুলো দিয়ে না এগিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান সড়কের কতগুলো জায়গায় অবরোধ সৃষ্টি করে। তাই ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট-নাটোরের সঙ্গে ঢাকা এবং রংপুর আর যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগব্যবস্থা তখনো অব্যাহত ছিলো। কতগুলো ঘাঁটিতে সেদিন লড়াইও হয়। একটি বড় লড়াই হয় লাকসামে। আরেকটা লড়াই হয় ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকবাহিনীর পরাজয় এবং পিছু হটার খবর আসতে থাকে একাত্তরের আজকের দিনে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। জামালপুরে বিমান হামলায় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। বিপুল সামরিক যান ধ্বংস হয়। চট্টগ্রামে পাক নৌবাহিনী ও মিত্র নৌবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে। বখশীগঞ্জ যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। জীবননগর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুরে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নেয়। বাংলাদেশের বিমানবাহিনী সিলেট সেক্টরে সাফল্যের সাথে বোমাবর্ষণ করে শত্রুর পাঁচটি বাংকার উড়িয়ে দেয় ও একডজন যানবাহন ধ্বংস করে। সম্মিলিত মিত্রবাহিনী ১৫টি ফ্রন্টে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রাখে। যশোর সেক্টরে কোটচাঁদপুর দখল করে তারা ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়। এ পথে মুক্তিবাহিনী খালিসপুর সেতুটি দখল করে এবং কুষ্টিয়ার কাজীপুরের পতন ঘটে। মিত্রবাহিনী তিতাস সেতু দখল করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে চলে। তারা সাফল্যের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়।
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী বিজয় লাভ করতে থাকে। পিছু হটতে থাকে পাকসেনা। একাত্তরের এই দিনে কুড়িগ্রাম, ফেনী, বিলোনিয়া, কুমিল্লার দেবিদ্বার, শেরপুরের ঝিনাইগাঁতী, যশোরের ঝিকরগাছা, মুন্সীনগর, রংপুরের পীরগঞ্জ, হাতিবান্ধা, পঞ্চগড়, বীরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা হানাদারবাহিনীর দখলমুক্ত হয়। যতই শত্রু হটানোর খবর চাউর হচ্ছে ততই স্বাধীনতাকামী মানুষসহ মুক্তিবাহিনী উজ্জীবিত হচ্ছে। ‘বাংলাদেশের জন্মগ্রহণ’ শীর্ষক গ্রন্থে (১২৩-১২৪ পৃষ্ঠা) মেজর জেনারেল রাও ফরমান লিখেছেন, “সকালে কুমিল্লায় ব্যাটালিয়ন আত্মসমর্পণ করার দুঃসংবাদ জানানো হয়। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হতে থাকে।”

Check Also

সেই জল্লাদ শাহজাহান এখন চা বিক্রেতা

কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার বড় মসজিদের মিনারের পাশেই নতুন চায়ের দোকান দিয়েছেন আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।