ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: সাদেকুর রহমান : “পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে দ্রুত হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ভারতীয় সেনাবহিনীর প্রধান দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এই আশ্বাস দেন যে, ‘আত্মসমর্পণ করলে পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে।’ জেনারেল মানেকশ’র এই আহ্বান আকাশবাণী বেতার থেকে নানা ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। পূর্ব সীমান্ত থেকে জেনারেল জগজিৎ সিংয়ের প্রায় সব কটা বাহিনী দ্রুতগতিতে ঢকার দিকে এগিয়ে আসছিল।”
নুরুজ্জামান মানিকের ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিন মার্চ-ডিসেম্বর ১৯৭১’ গ্রন্থে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে একাত্তরের আজকের দিনটিতে পাকহানাদার বাহিনী হটানোর বিবরণ। ঊনিশশ’ একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর বুধবার থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় আজ শুক্রবার। ছেচল্লিশ বছর আগেকার এই দিনে একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা ঘনীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে বিজয়ের চূড়ান্ত ক্ষণ নিকটবর্তী হচ্ছে। স্থানে স্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্মুখী আক্রমণে পরাস্ত পাকবাহিনী। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। মুক্ত স্বাধীন জনপদে পত্ পত্ করে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। এদিন পাকবাহিনী ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথই হানাদার বাহিনীর সামনে খোলা ছিল না। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেয়ারও কোন উপায় ছিল না।
এদিন সন্ধ্যায় সর্বশেষ সামরিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে ভারতের সরকারি মুখপাত্র ঘোষণা করেন, “পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে; বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই কোনো ভূখন্ড দখল কবরার অভিপ্রায় ভারতের নেই।”
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একাডেমির সাবেক পরিচালক কবি আসাদ চৌধুরী তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে একাত্তরের এ দিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেন এভাবে- “ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এসএইচএফ মানেক্শ’ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থা লক্ষ্য করে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তার ভাষণ বেতারে ঘন ঘন প্রচারিত হতে থাকে। তার বাণী প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহায়তায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর বিলি করা হয়।’ মানেক্শ বলেন, ‘অস্ত্র সংরক্ষণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস, ও দিয়ে আর কোনো সাহায্য পাবে না। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ এখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। … সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।’ পূর্ব সীমান্তে জেনারেল সগত সিং এর সব কয়টি ডিভিশনই তখন পশ্চিমে এগোচ্ছিলো। একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে আশুগঞ্জের দিকে এগোয়।”
উক্ত গ্রন্থে তিনি আরো লিখেন, “ওদিকে কুমিল্লার পতন ঘটেছে। সব পাক সৈন্য ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে। আরেকটি কলাম দাউদকান্দির দিকে। অপর একটি কলাম চাঁদপুরের দিকে। জামালপুর হালুয়াঘাটের দিকে আর একটি কলাম এগোলো। এদিকে বিমানবাহিনীর বিরামহীন আক্রমণ অব্যাহত রইলো। পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ সেনাবাহিনী আর পাচ্ছে না। আর এ আক্রমণে তাদের মনোবলও ক্রমশ নিঃশেষিত হচ্ছে। আবার সাগর পাড়ি দিতে হয়। এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস হলো। প্রস্তাবের উদ্যোক্তা মার্কিন সরকার। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়ে যাচ্ছিল। এবারো ফ্রান্স এবং বৃটেনসহ আটটি দেশ নীরব দর্শক। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য নয়। কাজেই এ ব্যাপারে ওদের কোনো মাথা ব্যথাও ছিলো না। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পূর্বেই বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে হবে।”
এদিন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাক সেনাদের প্রতিহত করে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে। ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পাক সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি লেফট্যানেন্ট জেনারেল একে নিয়াজীর সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ডা. এম এ মালিক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তার জবাব এসেছিল ৮ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক টেলেক্স বার্তায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য গবর্নরকে নির্দেশ দেন। এরপর কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে পাকসেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিভিশন অকেজো হয়ে পড়ে। দেশের দক্ষিণে খুলনাতেও আটকে পড়ে পাকসেনারা। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার মধ্যবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায় তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামেও পাকসেনারা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।
এদিকে, এদিন পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনী প্রধানের ঘোষণা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হতে থাকে। এরপরই মূলত পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এভাবেই স্বাধীনতার সংগ্রাম এগিয়ে যেতে থাকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রায় এদিন আরো মুক্ত হয় মৌলবীবাজার, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। মুক্ত জনপদবাসী বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। অন্যদিকে, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এদিন এক বেতার ভাষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান।
যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ৮ ডিসেম্বরের ঢাকার বর্ণনায় লিখেছেন, “সামনে এগিয়ে চলা ভারতীয় বাহিনীর কামানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ এখন ঢাকা থেকে শোনা যাচ্ছে, সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকা। শুধু কয়েকটি টেলিফোন কাজ করছে এবং টেলিগ্রাফ মাঝে মধ্যে সচল হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (অধুনা বন্ধ হোটেল রূপসী বাংলা), যেখানে আমি রয়েছি, সেখানকার বাগানে একদল লোক ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে।” পত্রিকাটির অপর এক খবরে বলা হয়, রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের এক সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী চমৎকারভাবে লড়ে চলেছে এবং যশোর ও সিলেটের পতনের খবর হচ্ছে ‘অবিশ্বাস্য রকম নির্লজ্জ মিথ্যাচার’।
এদিকে, পূর্ব সীমান্ত থেকে মিত্র বাহিনীর প্রায় সবকটি গ্রুপ দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল। একটি দল এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে ঢাকার দিকে। অপর একটি বাহিনী আশুগঞ্জের সেতুর দিকে এগোচ্ছিল। ৫৭তম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছায়। হানাদার বাহিনী এর আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে যায়। যুগপৎভাবে ‘এস’ ফোর্সও বিনা বাধায় সরাইলে পৌঁছায়। সন্ধ্যার মধ্যে ১১শ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্বপাশে আজমপুর এবং দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল এবং শাহবাজপুরের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়। যৌথবাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত।
এদিনের কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য কাজী ফজলুর রহমান। তিনি তার ‘দিনলিপি একাত্তর’ শীর্ষক গ্রন্থে মেদহীন বর্ণনা করেছেন এভাবে, “ভারতীয় বেতার আর বিবিসি’র খবর-যশোর বিমান ঘাঁটি আর ক্যান্টনমেন্ট দুই-ই মিত্র বাহিনী দখল করে নিয়েছে। পাক সেনাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় সব জেলা ও মহকুমা শহর থেকে, তার মাঝে ফেনীও আছে। এক কথায় ‘পৃথিবীর সেরা সৈন্যবাহিনী’ মার খেয়ে কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে ঢাকার দিকে। এর মাঝে প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামে ভারতীয় বিমান হামলা হয়েছে। রেডিওতে শুনলাম, কলকাতা বা আগরতলা থেকে নয়, এই হামলা হচ্ছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রণতরী ‘ভীক্রান্ত’ থেকে। আজ পাকিস্তানী এন্টি-এয়ারক্র্যাফটের আওয়াজও তেমন শোনা যায়নি। … জাতিসংঘে ডিবেট চলছে। চীন তর্জন-গর্জন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও পাকিস্তানের অখন্ডতার দোহাই দিচ্ছে, নানা প্যাঁচালো প্রস্তাব আনছে যুদ্ধ বিরতির জন্য। সোভিয়েতের একনিষ্ঠ ও দৃঢ় সমর্থন না হলে ভারত একা চীনা-মার্কিন উদ্যোগ ঠেকিয়ে রাখতে পারতো না। নানা বেতারের খবর শুনে তাই বোঝা যায়।”
০৮ ডিসেম্বর ২০১৭,শুক্রুবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/সংগ্রাম/আসাবি