ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:দীর্ঘদিন ধরে রাজপথের কর্মসূচি নেই বিএনপির। তবুও ঘরে থাকতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের একাধিক জেলায় চলছে পুলিশের অভিযান। চলছে নীরব ধরপাকড়। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে
দেশে ফেরার দুইদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে এমন পরিস্থিতি। তারপর তার কক্সবাজার সফর, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশকে কেন্দ্র করে এ ধরপাকড় চলেছে আরো দুই দফা।
কয়েকদিন আগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ও মঙ্গলবার আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মী। দৃশ্যত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ দেখালেও আদালতের বারান্দা আর কারাগারের চিত্র ভিন্ন। গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও নতুন মামলায় জামিনের জন্য আদালতের বারান্দা এখন মুখরিত বিরোধী নেতাকর্মীদের পদচারণায়। অন্যদিকে কারাগারগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ভিড়। কারাগার থেকে সম্প্রতি জামিনে মুক্ত কয়েকজন নেতা ও বিএনপিসহ অঙ্গ দলের নেতাকর্মীরা এমন তথ্য জানিয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দায়েরকৃত নতুন মামলা ও আসামির সংখ্যা এবং গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত রাতে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জুয়েলকে রাজাবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে ৫ই ডিসেম্বর বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার হাজিরাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীদের জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। সেদিন বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক ও মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কমিশনার রফিকুল ইসলাম রাসেলসহ অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একইদিন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহ-সভাপতি নবীউল্লাহ নবী, আরিফুল ইসলাম আরিফসহ অন্তত অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর নামে দায়ের করা হয় নতুন মামলা। পরদিন বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা নাদিম ও জাহাঙ্গীর আলম সনি। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিনের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে বের হবার পর ১৭ই নভেম্বর তোপখানা রোড থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানকে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর দুই মেয়াদে ১১ দিন রিমান্ড শেষে তৃতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচির আগের দিন পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আরিফুর রহমান নাদিম, কুমিল্লা মহানগর জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি উৎবাতুল বারী আবু, ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা সূত্রাপুরের হাজী লিয়াকত আলী, উত্তরা পশ্চিমের আবদুস সালাম, রূপনগরের আবদুস সাত্তার, রিপন, জালাল হাওলাদার, মানিক খান, ফারুক আহমেদ, মোহাম্মদপুরের মাসুদ সর্দার, মিলন খন্দকার, মিলন ঢালী, বিজয় খান, ইবরাহিম, রাশেদ, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা ছাত্রদল সভাপতি হুমায়ুন কবির, যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন পালোয়ানসহ ৫ জন, মুন্সীগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক রিফাতসহ ৪ জন ও ঘাট শ্রমিক দলনেতা আমির হোসেনসহ দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। একই দিন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, সহ-সভাপতি হামিদুর রহমান হামিদ, যুগ্ম সম্পাদক আলী রেজাউর রহমান রিপন, কাউন্সিলর মকবুল ইসলাম খান টিপুসহ ৬০ জন নেতাকর্মীকে আসামি করে দায়ের হয় নতুন মামলা। এর আগে ১০ই অক্টোবর নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ জেহাদ দিবসে জেহাদ স্কয়ারে ফুল দিতে গেলে তার ভাই সর্ব উদ্দিন ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিকসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। আদালতে যাওয়ার পথে ১৯শে অক্টোবর মৎস্যভবন এলাকা থেকে যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মজনুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদিকে নাটোরে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করে এক সপ্তাহ আগে নতুন একটি মামলা দিয়েছে পুলিশ। একই দিন বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নতুন মামলা হয় সাতক্ষীরায়। এর আগে কক্সবাজার সফরে যাওয়া-আসার পথে ফেনীতে দুই দফায় হামলার মুখে পড়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। পরে বাস পোড়ানোর অভিযোগে ১লা নভেম্বর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নঈম উল্লাহ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিনসহ ২৯ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত অর্ধশতাধিকের নামে মামলা করে পুলিশ। সেখানে বিএনপি ও ছাত্রদলের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এছাড়া ১১ই অক্টোবর সিরাজগঞ্জে ১০ জন, ১২ই অক্টোবর নোয়াখালীতে ২৮ জন, সিলেটে ২১ জন, ১৯শে নভেম্বর জয়পুরহাটে ৬ জন ও বরিশালের গৌরনদীতে ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এমন চিত্র প্রায় প্রতিদিনের এবং রাজধানীসহ সারা দেশের।
নীরব ধরপাকড় নিয়ে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজপথের কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি। তবু বিরোধী নেতাকর্মীদের ঘরে থাকতে দিচ্ছে না পুলিশ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে রাস্তার পাশে দাঁড়ানোর মতো নির্দোষ কর্মসূচিতেও হামলা চালাচ্ছে, গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই বিরোধী নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে পুলিশি অভিযান চালালো হচ্ছে। যাকে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন মামলায় যুক্ত করছে। জুয়েল বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেকটা নীরবেই চলছে এ ধরপাকড়। একই পরিস্থিতি অন্য সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও। ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা কারাগার বিরোধী নেতাকর্মী দিয়ে পূর্ণ করে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার বুঝতে পারছে তাদের পায়ের তলে মাটি নেই তাই দমন পীড়নের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে যত দমন পীড়নই হোক চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করা হবে। ওদিকে জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন বলেন, দেশে এখন বড় কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম নেই। কিন্তু আদালতের বারান্দা আর কারাগারে গিয়ে দেখুন- চিত্র একেবারে ভিন্ন। মাস দেড়েক ধরে নীরবে ধরপাকড় চলছে সবখানে। প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের একাধিক জেলায় বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে যুবদলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এক সপ্তাহ আগে হাতিরপুল থেকে একসঙ্গে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। তিনদিন পর বাংলা মোটর সোনারতরী টাওয়ারের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হলো ৫ জন। সব গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া মুশকিল তবুও যেটুকু খবর তথ্য আমাদের কাছে আসে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিনই সারা দেশে গড়ে ২০-৩০ জন যুবদল নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঘরেও থাকা যাচ্ছে না, বাইরেও থাকা যাচ্ছে না। ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ মামুন বলেন, পতনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে বর্তমান অবৈধ সরকার ততই জুলুম নিপীড়ন বাড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশি অভিযান, গ্রেপ্তার ও হয়রানির কারণে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এখন দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। কারাগারে ভিড় বাড়ছে, আদালতে পদচারণা বাড়ছে। তবে যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই আসুক আমরা পিছু হটবো না। এদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক দেড় মাসের বেশি সময় কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন গত সপ্তাহে। শহীদ জেহাদ দিবসে ফুল দিতে গেলে তাকেসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আশিক জানান, বিরোধী নেতাকর্মীদের মাধ্যমে ভরে ফেলা হয়েছে কারাগার। প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে সেখানে। তৈরি হচ্ছে অসহনীয় পরিবেশ। আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক মুন্না বলেন, কোনো না কোনো এলাকায় প্রতিদিনই ছাত্রদল নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে হানা দিচ্ছে পুলিশ। প্রতিদিনই চলছে গ্রেপ্তার। কিছু কিছু তথ্য কেন্দ্রীয় দপ্তরের মাধ্যমে প্রচার-প্রকাশ পেলেও বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। একই পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির দপ্তর সম্পাদক সাঈদুর রহমান মিন্টু। তিনি জানান, ঢাকা দক্ষিণের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতিদিনই থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের একাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
০৯ ডিসেম্বর ২০১৭,শনিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/ মানবজমিন/আসাবি