ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:রাজনীতির আকাশে ফের কালো মেঘ। সকালে সম্ভাবনার আলোর দেখা মিললেও বিকাল না গড়াতেই তা নিমজ্জিত হচ্ছে কালো অন্ধকারে। আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে বাড়ছে এ দূরত্ব। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপের বিষয়টি স্পষ্ট নাকচ করে দেয়া এবং বিএনপির কঠোর প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টি ফের অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। তারা মনে করেন, সম্প্রতি সরকার ও মাঠের বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড অনেকটা ইতিবাচক মনে হয়েছে। বিএনপিকে রাজধানীতে সমাবেশ করার অনুমতি সেই ইঙ্গিতই বহন করে। দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমার একটা প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুই দলের ফের বাহাসে রাজনীতি যেন আগের অবস্থানেই ফিরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে যা হওয়ার তাই হবে। অতীতের মতো ফের সংঘাত সংঘর্ষ। তবে দুই দলের অনড় অবস্থানের মধ্যে আশার আলো দেখছেন কেউ কেউ। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক কারণে দুই দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। কিন্তু সময় যত গড়াবে এ পরিস্থিতি ততটা পাল্টাবে। দুই দলই সমঝোতায় আসবে। সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে।
আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিতর্ক চলে আসছিল। এমন বিতর্কের মধ্যে আগাম নির্বাচনের গুঞ্জন এবং দুই দলের সংলাপ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা ছিল। রাজনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরছে- এমন একটা প্রত্যাশাও সবার মাঝে সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুই দলের সংলাপের সম্ভাবনা এবং আগাম নির্বাচন নিয়ে যে গুঞ্জন ছিল সেই বিষয়গুলো স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংলাপ এবং আগাম নির্বাচনের বিষয়টি নাকচ করে দেন তিনি। বিএনপিও কড়া ভাষায় এর জবাব দেয়। ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপির এমন কঠোর অবস্থান ফের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান মনে করেন, দুই দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো সদিচ্ছা বা লক্ষণ নেই। গণতন্ত্রের বিকাশ এবং আগামী প্রজন্মের কথা তারা ভাবছে না। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে দুই দলই মুখোমুখি অবস্থানে। মাঝে মাঝে সমঝোতার কিছুটা প্রত্যাশা সৃষ্টি হলেও তা কখনও আলোর মুখ দেখছে না। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও বিএনপির পাল্টা বক্তব্যে মনে হচ্ছে রাজনীতির আকাশ কালো মেঘে ডেকে যাচ্ছে। অতীতেও কালো মেঘই ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে তা সরে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলেও তা হয়নি।
তিনি বলেন, এ কালো মেঘ দূর করতে দুই দলকেই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দেশের কথা চিন্তা করে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতি ফের আগের অবস্থানেই চলে এসেছে। এ থেকে উত্তরণে কোনো লক্ষণও দেখছি না। কারণ, এক দলকে ক্ষমতায় যেতে হবে, আরেক দলকে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। সেটা তাদের কাছে মুখ্য। সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে গতিশীল করা এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলার কোনো লক্ষ্য তাদের নেই। দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে রাজনীতি ফের সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকট উত্তরণ বিশেষ করে সব দলকে নিয়ে সংলাপে বসার উদ্যোগ ক্ষমতাসীনদের নিতে হবে। কারণ, তারা ড্রাইভিং সিটে রয়েছে। তাই একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার উপায় খোঁজার দায়িত্ব সরকারের। তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসা, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করাই হলো গণতন্ত্র। সমস্যা সৃষ্টি করা নয়। তিনি বলেন, দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে আগামীতে ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছে না।
৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক সংকট আরও বেড়ে যায়। রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও, বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারে পরিস্থিতি অবনতির দিকে যায়। পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার তাগিদ দেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সুশীলসমাজসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীরা।
গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি অনেকটা ইতিবাচক মনে হয়েছিল। বিএনপি সংঘাতের রাজনীতি ছেড়ে ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরে আসে। সম্প্রতি সেরকম একটা আবহও তৈরি হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। তাতে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে নেবে, না নিলে না নেবে, সেটা তাদের দলের সিদ্ধান্ত, আমাদের কিছু বলার দরকার নেই। তবে, বিএনপি মনে হয় আর আগের মতো ভুল করবে না, নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে।
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরপর রাতেই এর তীব্র নিন্দা জানায় বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা যিনি সরকারের প্রধান, তার দায়। নির্বাচন করবেন কি করবেন না, নির্বাচন হবে কি হবে না, এটার দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। নাকে খত দিয়ে নয়, সব দলকে নির্বাচনে আনতে সরকারকেই বাধ্য হতে হবে- এমন মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নাকে খত দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। বরঞ্চ বর্তমানে যারা সরকারে আছেন, তাদের বাধ্য হতে হবে সব রাজনৈতিক দলগুলো যেন নির্বাচনে আসে তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে। এদিকে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি আরও কঠোর অবস্থানে। জিয়া পরিবারকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য প্রত্যাহার এবং ক্ষমা না চাইলে আইনের আশ্রয় নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুই দলে মুখোমুখি অবস্থান যেন আমাদের রাজনীতির একটা চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে এভাবেই চলবে।
সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে এমন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, উভয় দল এখন যার যার অবস্থানে অনড় আছে। তবে শেষ পর্যন্ত দুই দল কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।
০৯ ডিসেম্বর ২০১৭,শনিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/যুগান্তর/আসাবি