ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: :আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শতাধিক বিতর্কিত এমপির মনোনয়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দলীয়ভাবে ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জরিপ চালিয়ে বিতির্কত এমপিদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মতামত ও জনসমর্থনের দিক বিবেচনায় নিয়ে এসব এমপি মনোনয়ন নাও পেতে পারেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবেÑ এটা মাথায় রেখেই এমপি প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হবে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে যেসব এমপি বিভিন্ন সময় সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এবং দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন সেসব এমপিকে কোনোভাবেই মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে অনড় দলটির হাইকমান্ড। বিতর্কিত এমপিদের বিষয়ে ইতোমধ্যে কয়েক দফা তথ্য সংগ্রহ করেছে দলটি। সেগুলোও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে যেসব এমপির বিষয়ে একটু সন্দেহ রয়েছে পুনরায় তথ্য সংগ্রহ করে সংশোধিত তালিকায় তাদের নাম সংযুক্ত করা হচ্ছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এমন বার্তা দিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার গণভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, শত ফুল ফুটতে দিন। এটা তো সবার রাজনৈতিক অধিকার। তবে সবাই প্রার্থী হতে পারবেন না। আমরা শত ফুলের মধ্যে কোন ফুল সব থেকে ভালো ও সুন্দর, সেটা বেছে নেব। সময় এলে আপনারা দেখতে পাবেন কিভাবে বেছে নেব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জরিপ তো করতেই হবে। কে কিভাবে কাজ করছেন, কার কী পজিশন, জনগণের কাছে কার কতটা গ্রহণযোগ্যতা, সেই খোঁজ তো আমাকে নিতে হবে। যখন কারো কোনো দুর্বলতা দেখি, সাথে সাথে আমি তাকে সতর্ক করি। কাজেই একেবারে খুব খারাপ অবস্থায় যে কেউ আছেন তা নয়। কাজেই যেখানে যেখানে দুর্বলতা দেখি সেখানে পরিবর্তন হবে সেটাতো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই বেশ কিছু এমপি বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। অনেকেই তৃণমূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাজধানীতে সময় কাটিয়েছেন। আবার অনেকেই এমপিবলয় তৈরি করে এলাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে রেখেছেন। আবার অনেকের বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িতসহ নানা অভিযোগ তৈরি হয়েছে। ছয় মাস পরপর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এমপিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে এবং বিতর্কিত এমপিদের ডেকে সতর্কও করেছে হাইকমান্ড।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছেন এমন এমপিরাও এই তালিকায় আছেন। তাদের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সময় দলকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নানা অভিযোগ প্রকাশ হয়। গত নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার পরই এলাকা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর আগেরবার দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কবিরুল হক মুক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। অবশ্য জয়লাভ করার পরই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে নিজস্ব বলয় তৈরি করে রেখেছেন। এমপির দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ। ওই অংশটি গত মাসে গুলিস্তানের একটি হোটেলে সভা করে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর কালিয়া উপজেলায় এমপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য মো: অহিদুজ্জামান নয়া দিগন্তকে জানান, এমপির আগে তিন লাখ টাকাও ছিল না। এখন তিনি খুলনাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে কয়েকটি ফ্ল্যাট বাড়ি করেছেন। এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। হঠাৎ এত টাকা তিনি কোথায় পেলেন? তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে তার নিজের প্রার্থীর পক্ষে ভোট করেছেন। নড়াইল-১ আসনের ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতে হেরেছেন এমপির প্রার্থী।
নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় বেফাঁস মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের এমপি এবং মৎস্য ও পশু সম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক। ওই ঘটনায় দল ও সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। বিগত দিনে ইমেজ ভালো থাকলেও বয়সজনিত কারণে বাদ পড়তে পারেন তিনি। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বিদেশ থেকে পচা গম আমদানি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আছেন। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের ভাবমর্যাদা নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। তবে বিকল্প শক্ত প্রার্থী না পেলে হয়তো উৎরে যেতে পারেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় জামাতা তারেক সাঈদ জড়িত থাকা এবং ছেলে রনিকে নিয়ে একের পর নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হওয়ায় ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরা মায়া বেশ বিপদে আছেন।
অনুষ্ঠানের ব্যানারে নিজের নাম না থাকায় নিজ মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিবের কক্ষ ভাঙচুর, আরেক সিনিয়র সহকারী সচিবের কক্ষে তালা দেয়া এবং পুলিশ পেটানোর অভিযোগ থাকায় নেত্রকোনা-২ আসনের এমপি এবং যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। খুলনা-৬ আসনের এমপি মো: নুরুল হকের বিরুদ্ধে অন্যের জমিতে ইটের দেয়াল তৈরি করে একটি পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে।
কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি আব্দুর রহমান বদিকে নিয়েও বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। উপজেলা প্রকৌশলীকে মারধর, অবৈধ সম্পদ অর্জন, ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এ সরকারের আমলেই বেশ কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার ঘটনাটি নিয়ে বেশ বিপাকে আছেন টাঙ্গাইল-৩ আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা। তিনি বর্তমানে কারাগারে। নরসিংদী-৫ আসনের এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুও নিজ এলাকায় বিতর্কিত। এলাকার নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে উল্টো তাদের ওপর হামলা-মামলার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এ সরকারের শুরু দিকে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগের খবর বিভিন্ন সময় উঠে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধেও সন্ত্রাস, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগবাণিজ্য, টিআর-কাবিখা প্রকল্পসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। শেরপুর-৩ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হকের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর দুর্নীতি, ঘুষবাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ময়মনসিংহ-৩ আসনের এমপি মুজিবর রহমান ফকির ও তার ‘এইট্টি বাহিনী’র বিরুদ্ধে শিক্ষককে বাথরুমে আটকে রেখে নির্যাতন ও মারধর, শিক্ষককে দিগম্বর করে ঘোরানো, সাংবাদিক পেটানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ফেনীর সোনাগাজীর এমপি রহিম উল্যাহর বিরুদ্ধে নিজ দলের কর্মী আজিজুল হককে গুলি করে হত্যার সাথে জড়িত থাকাসহ বেশ কিছু অভিযোগ বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি পিনু খান তার ছেলে বখতিয়ার আলম রনির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে হাইকমান্ডের নেক নজর হারিয়েছেন। ফেনীর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুলক হককে হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর বিরুদ্ধে। জয়নাল হাজারী ও নিজাম হাজারী হত্যার দায়ভার একে-অপরের ওপরে চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা চালান। তবে ওই ঘটনা এখন অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। এ ছাড়াও বেশ কিছু এমপি হাইকমান্ডের নজরদারিতে রয়েছেন।
বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্নদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের অন্যতম সদস্য লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান নয়া দিগন্তকে জানান, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, কোনো রাজনৈতিক দলই হারার জন্য নির্বাচন করে না। আপনারা দেখবেন, যারা অতীতে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, যারা দলের জন্য বোঝা, এলাকায় জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন এবার তাদের কোনোভাবেই মনোনয়ন দেয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে জানান, এবার বাছাইটা অনেক নিপূণ হবে। যতদূর জানি, বিভিন্ন সোর্স থেকে বর্তমান এমপিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। কিছু দিন পরপর সেগুলো আপডেট করা হয়। তিনি বলেন, যার ব্যাপারে একটু সন্দেহ হয়, তার বিষয়ে আবারো তথ্য সংগ্রহ করে নতুন করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয় ঠিক রেখে এলাকায় বেশি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে।
১০ ডিসেম্বর ২০১৭,রবিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/নয়া দিগন্ত/আসাবি