ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট:আজ রোববার মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের দশম দিন। একাত্তরের এ দিনটি ছিল শুক্রবার। মসজিদে মসজিদে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতি এবং যুদ্ধে পাকসেনাদের সাফল্য কামনা করে বিশেষ মুনাজাতের আয়োজন করা হয়। কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষের আকুতির কাছে তা যেনো তুচ্ছ। লড়াকু স্বাধীনতা সৈনিকদের অব্যাহত আন্দোলন চলছে। চতুর্দিক থেকে হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত ও জনপদ শত্রুমুক্ত করার সুখবর আসছে। একাত্তরের এদিন থেকেই মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ঘনিয়ে আসতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা ‘বিজয় কবে হবে’ প্রশ্নের উত্তর পেতে শুরু করে।
রণাঙ্গনে ‘মুক্তি’ শব্দটি আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে নিজেদের প্রবল প্রতাপশালী মনে করা পাক সৈন্যদের কাছে। হানাদার বাহিনী যুদ্ধের মাঠে দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। ফলে সেন্যদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কায় লে. জেনারেল নিয়াজী পালাবার পাঁয়তারা করে। তার গোপন এই অভিসন্ধি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ফাঁস করে দেয়। এদিন মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ করে এবং কুর্মিটোলার ওপর বারবার রকেট হামলা অব্যাহত রেখে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করেছে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রুবাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত সমকালীন উল্লেখযোগ্য কবি আসাদ চৌধুরী তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে এদিনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন এভাবে- “মেঘনা দুস্তর বাধার মতো দাঁড়িয়ে আছে মিত্রবাহিনীর জন্য। হেলিকপ্টার দিয়ে মিত্রবাহিনী পেরুলো মেঘনা। হাজার হাজার গ্রামবাসী ছুটে এলেন। রাশিয়ান ট্যাংকে কাছি দিয়ে বেঁধে টেনে তুললেন ওপারে। এদিকে বিমান আক্রমণে রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র স্তব্ধ। স্টিমারে করে পাকবাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়লো। পাকিস্তানের বাণিজ্য জাহাজও আক্রান্ত হলো।”
দৈনিক পাকিস্তান ও আজাদের খবর অনুযায়ী, অবস্থা বেগতিক দেখে লে. জেনারেল নিয়াজী তার দুর্বলতা ঢাকার জন্য আজ কন্টিনেন্টাল হোটেলে (বর্তমানে বন্ধ হোটেল রূপসী বাংলা) গিয়ে দম্ভভরে বলেন, কোথায় বিদেশী সাংবাদিকরা, আমি তাদের জানাতে চাই, আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাবো না। অন্যদিকে আজ সরকারিভাবে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি মি. আগাশাহী জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব মি. উথান্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ব্যক্ত করে। চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. চি পো ফেই বলেন, ভারতের কার্যকলাপে তার সম্প্রসারণবাদী নগ্নরূপ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রী সা¤্রাজ্যবাদীরা নির্লজ্জের মতো ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের ত্রাণকর্তার ভূমিকা গ্রহণ করে বর্বরোচিত কাজ করছে।
এদিন শত্রুমুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার লাকসাম। সেখানে পাঁচ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল। পরদিন পাকবাহিনীর ঢাকায় ফিরে আসার চেষ্টা সবদিক দিয়ে ব্যর্থ হয়। মুক্তিবাহিনী ঢাকা দখল করে নেয়ার জন্য এদিন প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। ভৈরব বাজার থেকে মিত্রবাহিনীর ৫৭ নম্বর ডিভিশন ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়েছিল। টাঙ্গাইল ছাড়া ঢাকার আশপাশের সকল এলাকাই এদিন শত্রুমুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধানের পক্ষ থেকে এদিনই পাকিস্তানী বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের অনুমতি দেয়া হয়। এদিন আরো যেসব এলাকা হানাদারমুক্ত হয় ভোলা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ও মধুপুর, মুক্তাগাছা, নড়াইলের বালিয়া, নড়াইল, নরসিংদীর রায়পুরা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, মাদারীপুর ইত্যাদি। একাত্তরের এই দিনে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে দায়িত্ব পালন করছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন। পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে প্রতিরোধ গড়ে শহীদ হন এই যোদ্ধা।
এদিকে, এদিন চীনা বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয় দৈনিক পাকিস্তানে। সিনহুয়া ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান পাকিস্তান বিভক্ত করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে। সমালোচনায় বলা হয়, এতে মদদ দিচ্ছে সামাজিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি সোভিয়েত সরকার। ভারত এপ্রিলের দিকে কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদীকে একত্রিত করে তথাকথিত অস্তিত্বহীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
অন্যদিকে প্রত্যক্ষদর্শী স্বজনদের বিবরণে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত প্রায় তিনটায় দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের রাজধানীর ৫ নং চামেলীবাগের (শান্তিনগর) বাসার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। বাড়িওয়ালা ডা. শামসুল হুদার কণ্ঠস্বর শোনা গেল ‘শাহীন দরজা খোল’। সিরাজুদ্দীন হোসেনের মেঝো ছেলে শাহীন রেজা নূর দরজা খুলে দেন। দরজা খুলতেই চোখে পড়ে শামসুল হুদা ও তার দুই ছেলে বন্দুকের নলের মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পেছনে সশস্ত্র বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে শাহীনকে বন্দুকের মুখে আটকে ফেলে তারা। সবার মুখ ঢাকা। এ সময় তার সেজো ছেলে ফাহিম রেজা নূর ছুটে যায় তার বাবাকে আড়াল করবার জন্য। কেউ কিছু না বললেও সিরাজুদ্দীনের পরিবারের সদস্যদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি তারা কেন এসেছে।
সিরাজুদ্দীন হোসেন লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরেছিলেন। সেই প্রচন্ড শীতের রাতে কোনো জামা পরার সুযোগও দেয়া হলো না তাকে। ঘরে গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হলো তার। তাকে নিয়ে যাবার সময় স্ত্রী নূরজাহান সিরাজী ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সেই যে গেলেন আর ফিরে আসেননি। লাশও পাওয়া যায়নি এই প্রথিতযশা সাংবাদিকের। পাকবাহিনীর দোসররা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে যাবার মধ্য দিয়েই শুরু করে ঘৃণ্য এই পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তান ও তাদের দোসর রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা চালাচ্ছিল। এতদিনে তারা বুঝে গেছে এ যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা একদমই নেই। এ সময় তারা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
১০ ডিসেম্বর ২০১৭,রবিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/প্রতিনিধি/আসাবি