ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে চার সহস্রাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮৫৫টি হত্যাকাণ্ড। গুম বা নিখোঁজ হয়েছেন ৫২ জন। বন্দুকযুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৮৩ জন। এছাড়া ৫ বছরে নিখোঁজ হয়েছেন ৫২০ জন।
সবশেষ মঙ্গলবার নিখোঁজ হয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। সাংবাদিক উৎপল দাস নিখোঁজের দু’মাস পার হলেও এখনও তার সন্ধান মেলেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। খুনের শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশুও। নিখোঁজ বা গুমের শিকার হচ্ছে মানুষ। বাসা, অফিস, রাস্তা থেকে হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছেন অনেকে। আবার অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন।
এমন অবস্থার মধ্যেই আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সালে দিনটিকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- সততা, ন্যায়বিচার এবং মানবিকতা।
বাংলাদেশে দিনটি সরকারিভাবে পালনের জন্য দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার বাণীতে সরকারের পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষায় নিয়োজিত বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অনুসারে, এ ছয় মাসে প্রতিদিন গড়ে ২৩টির বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। মোট মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ৪ হাজার ২৪০টি। এর মধ্যে ৮৫৫টি হত্যাকাণ্ড। গুম বা নিখোঁজ হয়েছেন ৫২ জন। বন্দুকযুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৮৩ জন। একই সময়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৯৩ জন। নির্মমতা থেকে বাদ যাচ্ছে না নারী-শিশুও। হত্যার শিকার হয়েছে ১২৯ শিশু। আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৩ শিশু। বছরের প্রথম ৬ মাসে ৩০৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যৌন নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিক্ষেপসহ আরও বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৯৯ নারী। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অমানবিক শাস্তির শিকার ১২৭ শিশু শিক্ষার্থী।
পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে অনুসারে, পুলিশের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১২৭টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিকেও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করা হয়েছে পর্যবেক্ষণে। ৬ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৮৫৩ যাত্রী ও পথচারী।
তবে বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে খুন ১০৫২, শিশুহত্যা ১৯৭, গণধর্ষণ ৭৭ ও ক্রসফায়ারে মৃত্যু ১৫৭ জনের। ২০১৭ সালে (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর) সেটি এসে দাঁড়িয়েছে- খুন ৮৮৪, গণধর্ষণ ৭২২, ক্রসফায়ারে মৃত্যু ৯৩ জন ও শিশুহত্যা ৩১৩।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক যুগান্তরকে বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এটি সত্য। বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরেছি এবং যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। এ ক্ষেত্রে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান। রিয়াজুল হক বলেন, বিচারবহির্ভূত একটি হত্যাকাণ্ডও যেন আর না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সংবিধানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার থাকলেও জনগণ তা কতটুকু ভোগ করেছে সেটাই দেখার ব্যাপার। সার্বিকভাবে বলতে গেলে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে গুম ও খুনের সংখ্যা। খুনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে আরও ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে। এখানে দিন-দুপুরে মানুষ গুম হয়, কিন্তু কেউ স্বীকার করে না। সরকার সব সময় এটি অস্বীকার করে। অথচ গুমের ঘটনা বাড়ছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এ বছরের প্রথম ছয় মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি ৮৫৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে কম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারিতে, ৩৬১টি। প্রতি মাসে গড়ে ৭ শতাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়।
এ ছয় মাসে সংঘটিত ৮৫৫টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি ১৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটে। জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি ৪২ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। মার্চ ও মে মাসে সর্বাধিক ৬৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ৫২ গুমের মধ্যে ১৪টি হয় মার্চে। আর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ২০টি করে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা ঘটে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক শরীফ উদ্দীন বলেন, অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তের পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করছে। দেশে আগেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটত। তবে এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ছে। পর্যবেক্ষণেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে।
১০ ডিসেম্বর ২০১৭,রবিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/যুগান্তর/আসাবি