আজ সোমবার। মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের একাদশ দিন

সাদেকুর রহমান : আজ সোমবার। মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের একাদশ দিন। ১৯৭১ সালে ক্যালেন্ডারের পাতায় এদিনটি ছিল শনিবার। এদিনও বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে সম্মুখ সমর চলে। তবে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে স্বাধীনতাকামী এ দেশবাসীর মনে বিজয়ের আশা-প্রত্যাশা বহুগুণে বেড়ে যায়। স্বাধীনতা লাভ প্রশ্নে যে সংশয়, কালো মেঘ দেখা দিয়েছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। এদিনের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল টাঙ্গাইল শহরের মুক্তি অর্জন, যার মধ্য দিয়ে ঢাকা মুক্ত তথা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পথ খুলে গিয়েছিল। একাত্তরে এদিন পর্যন্ত  দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে এদিন  জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশী নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়।
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এদিন যশোর গেলেন সরেজমিন পরিদর্শন করতে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সদলবলে প্রধানমন্ত্রীর সফর এই প্রথম। এর আগেও গেছেন মুক্ত-অঞ্চলে, কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সন্তর্পণে এবং যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়ে। এবারের পরিদর্শন বিজয়ীর বেশে এবং প্রকাশ্যে। ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখার মতো! সকলেই উল্লসিত। মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের আগের মালিককে সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের সমঅধিকার এবং চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ। এদিনই বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউসে বলেন, “তারা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবেন, যা ২৪ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি।”
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একাডেমির সাবেক পরিচালক কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়, “১১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। মুক্ত হলো জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ। শত শত পাকসেনা আত্মসমর্পণ করছে। জামালপুরেই আত্মসমর্পণ করলো ৫৮১ জন। মতলবে পাকসেনা আত্মসমর্পণ করলো। বিমানবাহিনী সেদিন ঢাকা এবং করাচীতে কোনো আক্রমণ করেনি। ঢাকা থেকে বিদেশীদের যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল মিত্রবাহিনী, তাছাড়া রানওয়ে মেরামতেরও সুযোগ ছিল। চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে বিমানবাহিনীর আক্রমণ ছিল প্রচন্ড।”
দৈনিক আজাদ ও পূর্বদেশ পত্রিকার বরাত দিয়ে গ্রন্থটিতে আরো বলা হয়,“মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যুগপৎ আক্রমণে হানাদার ঘাতকদের পরাজয় এক রকম সুনিশ্চিত হয়ে যায়। ঘাতকরা যখন উল্লাসে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল সে সময় পাকিস্তানের মিত্ররা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবার জন্যে জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র মি. রোনাল্ড জিগলার বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। একই দিন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নিহাত করিম এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান সংকটকে সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন, “কেউ শক্তি প্রয়োগ করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু ভারত এবং তার মিত্ররা তাই করছে। সন্তোষজনক সমাধান করতে হলে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি এবং পাকিস্তানের দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে হবে।”
জামালপুর থেকে আগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোন টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। সম্মিলিত বাহিনীর এই অংশটিই প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনায় এই দলের ভূমিকা ছিল প্রধান। জামালপুর পতনের পর টাঙ্গাইলে অবস্থানরত পাক সেনারা শহর ছাড়তে শুরু করে। ঢাকা আসার পর সেদিন প্রায় চার হাজার পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিল।
এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় কোনো হামলা চালায়নি। বিদেশী যাত্রীদের সুবিধার্থে তেজগাঁও বিমানবন্দরে মেরামত ও যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। পাকসেনাদের ওপর ঢাকা ত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ডা. এম এ মালিক জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এ আহ্বান কোনো কাজে আসেনি। পাকসেনাদের সামনে একটি উপায় ছিল আত্মসমর্পণ করা। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তানীদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জরুরি আবেদন জানান। এদিকে ঢাকায় বিকাল তিনটা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মালিকের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নাকচ করে দেন। সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখা রিপোর্টে উল্লেখ করেন, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গবর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। শর্তগুলো হচ্ছে: ১. পাকিস্তানী বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ২. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোনো লিখিত চুক্তি করবে না। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে নিজ দেশে ফেরত যেতে দিতে হবে। ৪. এরপর পাকিস্তানী সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে দিতে হবে। ৫. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাব নাকচ করেন। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানকে যুদ্ধ সহায়তা দেয়ার দাবি জানান।
রণাঙ্গনে যৌথবাহিনীর সাথে বিভিন্ন স্থানে জোর সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। কোনো সংঘর্ষেই পাকবাহিনী যৌথবাহিনীর সুসংগঠিত আক্রমণের মুখে টিকতে পারছিল না। কোথাও তারা আত্মসমর্পণ করছিল। কোথাও পালিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা করছিল। এই পালাবার পথে পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা চালায়। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে করতে তারা পিছিয়ে যেতে থাকে। এমনকি পরাজয় নিশ্চিত জেনে যখন পাকিস্তানী   সৈন্যরা ঢাকায় সাহায্যের বার্তা পাঠাচ্ছিল তখন ঢাকা থেকে কোনো সাহায্য পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়। অথচ এদিন লে. জেনারেল নিয়াজী ঢাকা বিমানবন্দর পরিদর্শন করতে এসে দম্ভভরে বলেন, কোনোক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া চলবে না। পাকবাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে আরো উজ্জ্বল করবে। পরে বিমানবন্দরে তিনি বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন।
মুক্তিবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি পড়ে। মার্কিন সপ্তম নৌবিহারের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলছে। মৌলবীবাজারের পতন আর নরসিংদীতে যৌথবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠা হয়। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকবাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারা রাত যুদ্ধের পর হানাদাররা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
জামালপুর গ্যারিসন সম্মিলিত বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচন্ড সংঘর্ষের পর হানাদারবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। পলায়নের সময় শত্রুবাহিনী রাস্তার সমস্ত বড় বড় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অপরদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত শত্রুবাহিনীর আর একটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরোধে জামালপুর দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ৬ দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচন্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানী বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ৬ জন অফিসার ও ৫২২ জন সেনা যৌথবাহিনীর আছে আত্মসমর্পণ করে। হানাদারদের মধ্যে নিহত হয় ২১২ জন আর আহত হয় ২০০ জন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলা ও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে ১১ ডিসেম্বরের প্রধান প্রধান ঘটনা আলোকপাত করেছেন, (ক) পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে তারবার্তা প্রেরণ। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক এই সংবাদের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং জাতিসংঘে অবস্থানকারী প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক এই আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। (খ) বগুড়া ও ময়মনসিংহ এলাকা মুক্ত ঘোষণা। (গ) ঢাকার অদূরে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর প্যারাস্যুটের মাধ্যমে অবতরণ। রাজশাহী, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ মুক্ত ঘোষণা। (ঘ) মার্কিন সপ্তম নৌ-বহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের গুজব প্রচার।
একাত্তরের আজকের দিনে এছাড়াও নরসিংদীর রায়পুর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, যশোরের মনিরামপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, রংপুরের পীরগাছা, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লার লাকসাম, দিনাজপুরের হাকিমপুর ও ময়মনসিংহের নান্দাইল শত্রুমুক্ত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত সময়ে টাঙ্গাইল শহরের মুক্তি অর্জন ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কেননা টাঙ্গাইল শহর মুক্ত করার মধ্য দিয়ে ঢাকা মুক্ত করার এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পথ খুলে গিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার উজ্জ্বল পথ সুগম ও সুনিশ্চিত হয়েছিল।

১১ ডিসেম্বর ২০১৭,সোমবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/প্রতিনিধি/আসাবি

Check Also

সেই জল্লাদ শাহজাহান এখন চা বিক্রেতা

কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার বড় মসজিদের মিনারের পাশেই নতুন চায়ের দোকান দিয়েছেন আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।