ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:২৬ সেপ্টেম্বর। কাকডাকা ভোর। রাজধানীর প্রগতি সরণিসংলগ্ন একটি আবাসিক এলাকায় সাদা পোশাকে ঘোরাফেরা করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (নারকোটিক্স) কয়েকজন কর্মকর্তা।
গোপন সূত্রে মাদক ব্যবসার খবর পেয়ে এলাকাটির জি-ব্লকের একটি বাড়ির ওপর নজর রাখছেন তারা। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আনাগোনা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের। অনেকটা লাইন ধরে বাড়িতে ঢোকার মতো অবস্থা। আবার অল্প কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে যাচ্ছেন সতর্ক ভঙ্গিতে। তবে শেষতক যে তথ্য পাওয়া গেল তা খুবই ভয়ঙ্কর। নিষিদ্ধ মাদকের নেশায় বাড়িটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের এমন আবাধ আনাগোনা।
বেলা তখন ১১টা। দীর্ঘ সময় নজরদারির পর বাড়িটিতে ঢোকার প্রস্তুতি শুরু হলো। নারকোটিক্সের একটি অগ্রগামী টিম জি ব্লকের ১৩ নম্বর রোডের ১৮/ই নম্বর বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। বহুতল এই ভবনের দোতলায় একটি ফ্ল্যাটের দরজায় নক করা হল। কয়েকবার নক করার পর ভেতর থেকে পরিচয় জানতে চাইলেন কেউ একজন। বাইরে থেকে অভিযান দলের সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দিলেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে সালাম দিলেন টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। তাকে সরিয়ে অভিযান দলের কয়েকজন সদস্য ভেতরে ঢুকলেন। তারা গৃহকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন।
এরপর সামনে এগিয়ে এলেন গৃহকর্তা। তার বয়স আনুমানিক ষাটের কাছাকাছি। মাদকের টিম দেখে খুবই বিক্ষুব্ধ তিনি। ইংরেজি ভাষার আমেরিকান উচ্চারণে একরকম গালাগাল শুরু করলেন। ভাবখানা এমন যে, মাদকের টিম ভুল করে কোনো এক সভ্রান্ত ব্যক্তির বাসায় ঢুকে পড়েছে। গৃহকর্তার এমন আচরণে কিছুটা বিব্রত ও বিভ্রান্ত অভিযান দলের সদস্যরা। তবে ঢুকেই যখন পড়েছেন তখন তল্লাশি না করে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই নিশ্চিত হতে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে তারা গোপন সোর্সকে আবারও ফোন করেন। সোর্স পুনরায় নিশ্চিত করলেন, ঠিকানা ও ফ্ল্যাট নম্বর সবই ঠিক আছে। তল্লাশি করলেই বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল পাওয়া যাবে।
সোর্স আরও জানায়, যিনি ইংরেজিতে অনর্গল কথাবার্তা বলছেন তিনিই মূল মাদক ব্যবসায়ী। তার নাম শহিদুজ্জামান ওরফে নাভিদ।
এবার আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা নয়। নারকোটিক্সের কর্মকর্তারা ফের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লেন। সরাসরি নাভিদকে জেরা করা শুরু হল। বাংলায় প্রথম প্রশ্ন ছিল- আপনি কী করেন? নাভিদ ইংরেজিতেই উত্তর দেন। বলেন, ‘আমি একটি কলেজের প্রভাষক। গবেষণা ও লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত আছি। বোঝা গেল তিনি বাংলা বোঝেন। এরপর একের পর এক প্রশ্ন। কিন্তু তার জবাবের বেশির ভাগ শব্দ ও বাক্য ছিল হুমকিধমকিতে ভরা। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন অমুক মন্ত্রী তার আত্মীয়। অমুক প্রভাবশালী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা জানতে পারলে আপনাদের সবক’টার চাকরি যাবে… ইত্যাদি।
কিন্তু নিশ্চিত তথ্য থাকায় নাভিদের কথায় আর বিভ্রান্ত হননি অভিযান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জেরার সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্ল্যাটের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু হয়। কিন্তু প্রথম দিকে হতাশ হতে হয়। বিলাস বহুল উপকরণে সাজানো ফ্ল্যাটে মাদক ব্যবসার কোনো চিহ্ন নেই।
অভিযান যখন প্রায় ব্যর্থ, ঠিক তখনই অভিজ্ঞ সিপাই সালাউদ্দীনের নজর পড়ে নাভিদের শোবার ঘরের বিছানায়। কারণ বিছানার ম্যাট্রেস অস্বাভাবিক মোটা দেখা যায়। চাদর উঠিয়ে ম্যাট্রেসের চার দিক পরীক্ষা করতেই একদিকে বড় ফোকর দেখা যায়। ফোকরের মুখে আলগা কাপড় দিয়ে ঢাকা।
সেটা সরাতেই দেখা যায়, ম্যাট্রেসের ভেতর সারি সারি ফেনসিডিলের বোতল। সেখান থেকে বের করা হয় ৫০ বোতল। খাটের নিচে বিশেষ ব্যবস্থায় লুকিয়ে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায় আরও ৫০ বোতল। অগত্যা নাভিদের হাতে হাতকড়া পরাতে বেশি একটা সময় নেননি অভিযান টিমের সদস্যরা।
ঘটনাস্থলেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এবার নাভিদের চেহারা ভিন্ন। একেবারে ৩৬০ ডিগ্রির বিপরীতে। হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়া শুরু করেন। বলেন, আমি এই ব্যবসা ছেড়ে দিব। এবারের মতো আমাকে ছেড়ে দেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের ঘুষেরও প্রলোভন দেন। কিন্তু নারকোটিক্সের কর্মকর্তারা নাছোড়বান্দা। নাভিদকে গ্রেফতারের খবর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হলে নেটওয়ার্কের অন্য সদস্যদেরও গ্রেফতারের নির্দেশ আসে।
জিজ্ঞাসাবাদে নাভিদ জানান, তিনি আদৌ কোনো শিক্ষক নন। তবে ব্যবসার সুবিধার্থে তিনি শিক্ষকের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। কারণ তার মূল ক্রেতা পার্শ্ববর্তী দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দিনভর প্রচুর ছাত্র তার ফ্ল্যাটে ফেননিডিল কিনতে এলেও আশপাশের বাসিন্দারা সন্দেহ করেন না। প্রতিবেশীরা মনে করেন, শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা পড়ালেখার জন্যই আসে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, নাভিদকে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালেই সেখানে ফেনসিডিল কিনতে এসে একে একে আটক হন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থী। পরে তাদের শিক্ষাজীবনের কথা চিন্তা করে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়।
নারকোটিক্সের কর্মকর্তারা জানান, নাভিদ সাধারণ কোনো মাদক ব্যবসায়ী নন। তিনি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মাদকের বিশবাষ্প ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। নিজের ফ্ল্যাটে মাদক ব্যবসা ছাড়াও প্রগতি সরণিতে তিনি নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে অভিনব উপায়ে ভ্রাম্যমাণ ফেনসিডিল বিক্রি করেন। এ এলাকায় তার একাধিক মোটরসাইকেল এজেন্টও আছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা নাভিদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রগতি সরণি থেকে শাহিন ও শান্ত নামের দুই এজেন্টকেও গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। তাদের কাছ থেকে ১০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
অভিযান দলের নেতৃত্বদানকারী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইন্সপেক্টর একেএম কামরুল ইসলাম জানান, নাভিদ বেশ কয়েক বছর আগেও মাদক ব্যবসা করতেন। মাঝখানে এ ব্যবসা ছেড়ে জীবিকার উদ্দেশে কানাডায় পাড়ি জমান। কিন্তু বিদেশে সুবিধা করতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন। এরপর ফের নেমে পড়েন পুরনো মাদক ব্যবসায়।
এবার তার সঙ্গে এসএম সামসুল আলম ওরফে সজিব নামের আরেকজন বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠতা হয়। সজিবের সঙ্গে নাভিদ যৌথভাবে মাদক ব্যবসা করেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনসিডিলের চালান আনেন সজিব। আর ফ্ল্যাটে খুচরা ও পাইকারিভাবে বিক্রি করেন নাভিদ।
দিনভর টানা অভিযানের একপর্যায়ে বিশেষ কৌশলে ৫০ বোতল ফেনসিডিলসহ সজিবকেও গ্রেফতার করতে সক্ষম হন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পরে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জের ফেনসিডিল ‘মোকাম’ থেকে তিনি মাসে কয়েকবার ফেনসিডিলের চালান আনেন। এ জন্য প্রিমিও ব্র্যান্ডের একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। আর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে তিনি ওই গাড়িতে র্যাবের যানবাহনে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের হর্ন লাগান। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে নারায়ণগঞ্জের দু’জন বড় মাপের ফেনসিডিল ব্যবসায়ীর নাম বলে দেন তিনি। এদের একজনের নাম নবির হোসেন এবং অপরজন মিজানুর রহমান।
গ্রেফতারকৃত সজিব বলেন, নারায়ণগঞ্জের এ দু’জন মাদক ব্যবসায়ী মূলত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেনসিডিলের অর্ডার নিয়ে থাকেন। পরে তাদের গ্রেফতারের জন্য কৌশলের আশ্রয় নেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ জন্য সজিবের মোবাইল থেকে ফেনসিডিলের অর্ডার দেয়া হয়।
এরপর অপেক্ষা চলতে থাকে। দেড় ঘণ্টার মধ্যেই মোটরসাইকেলযোগে ফেনসিডিল নিয়ে হাজির হন নবির ও মিজান। মেহেদী মার্টের সামনে এসে তারা ফেনসিডিল ডেলিভারি নেয়ার জন্য সজিবের মোবাইলে কল দেন। এরপর ক্রেতার ছদ্মবেশে গিয়ে তাদের দু’জনকেও গ্রেফতার করেন মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল হক।
এরপর গ্রেফতার ছয়জনকে নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁওয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌথ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) ডিআইজি সৈয়দ তৌফিক উদ্দীন আহমেদ নিজেই গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সেখানে তারা অকপটে মাদক ব্যবসার স্বীকারোক্তি দেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিআইজি সৈয়দ তৌফিক উদ্দীন আহমেদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, শহিদুজ্জামান ওরফে নাভিদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মাদক ব্যবসায়ী চক্র দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীতে ফেনসিডিলের ব্যবসা করে আসছিল। তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদক ব্যবসার কাজে তারা যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন সেটিও আটকের পর প্রধান কার্যালয়ে এনে তিনি নিজে পরীক্ষা করে দেখেন গাড়ির অভ্যন্তরে ফেনসিডিলের উৎকট গন্ধ। অর্থাৎ গাড়িটি দীর্ঘদিন ধরেই ফেনসিডিল বহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই চক্রের অনেকের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালীর যোগাযোগ ছিল। তবে মাদক ব্যবসায়ী যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তাকে ছাড় দেয়া বা সমীহ করার কোনো সুযোগ নেই।