যে তথ্য প্রকাশ হল তাতে বাচ্চু যে অপরাধী এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই দুদকের হাত আরও শক্তিশালী হল, এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে দুদককে ব্যবস্থা নিতে হবে -টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান
শুধু কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে শত শত কোটি টাকা ঋণ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজেও প্রতিষ্ঠান খুলেছেন ভুয়া ঠিকানা দিয়ে। আর সেই কাগুজে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করেছেন বেসিক ব্যাংকের বিতর্কিত চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। যমুনা টিভি মঙ্গলবার এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে বাচ্চুর রহস্যজনক লেনদেনের তথ্য। এ টাকা বেসিক ব্যাংকে ঋণ লোপাট করা অর্থের কিছু অংশ। বিশেষজ্ঞরাও এমনটি মনে করেন।
জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, মূলত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ভুয়া না সঠিক তা জানার একমাত্র উপায় কেওয়াইসি (ব্যাংক হিসাব খুলতে গেলে যে ফরমটি পূরণ করতে হয় তার সংক্ষিপ্ত নাম) মেনে চলা। কেওয়াইসি হল নো ইউর কাস্টমার বা তোমার গ্রাহককে চেনো। এখানে সেটা হয়নি বলে একের পর এক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়া সম্ভব হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আজকে যে তথ্য প্রকাশ হল তাতে বাচ্চু যে অপরাধী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে দুদকের হাত আরও শক্তিশালী হল। এখন তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত দুদকের। এক্ষেত্রে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে দুদককে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে আমরা অবাক হব এবং দুদকের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেভাবে টাকা-পয়সা নয়ছয় করেছেন বাচ্চু তাতে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্ধ করা উচিত। একই সঙ্গে তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাহলে শুধু বাচ্চু নয়, তার পেছনেও যদি কোনো প্রভাবশালী থাকে তাকেও ধরা সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, বাচ্চুকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দুদককে দিয়েছি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্ধের বিষয়টি তারা চায়নি তাই দেয়া হয়নি। যদি তদন্তের স্বার্থে আরও কিছু চাই তাহলে তাও দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদুক ৫৬টি মামলা করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেখানে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। অথচ বাচ্চুর বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নিতে সোচ্চার ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংসদীয় কমিটি। কিন্তু এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না দুদকের। তবে বিলম্বে হলেও দুই বছরের বেশি সময় পর অবশেষে সম্প্রতি বাচ্চুকে দু’দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদুক। সূত্র জানায়, অনেক মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি বেসিক ব্যাংকের সাবেক এ চেয়ারম্যান। যদিও তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ঋণ অনিয়মের বিষয়টি তিনি জানতেন। তবে পর্ষদের সবার সম্মতিতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তিনি একা দায়ী নন।
এদিকে যমুনা টিভির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আবদুল হাই বাচ্চুর আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। খোদ চেয়ারম্যান হয়ে তিনি কিভাবে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা নিয়েছেন তার প্রমাণ মিলেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চেয়ারম্যান হওয়ার পর ২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড নামে কোম্পানি খোলেন বাচ্চু। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টকের তথ্য অনুযায়ী ইডেন ফিশারিজের চার পরিচালক হলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। কোম্পানির ঠিকানা দেয়া হয় ৪২/১-ক, জাহান প্লাজা, সেগুনবাগিচা। কিন্তু উল্লিখিত ঠিকানায় আদৌ বাচ্চুর কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না কখনও। সবই ভুয়া এবং কাগুজে প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়।
এ প্রসঙ্গে জাহান প্লাজার মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ইডেন ফিশারিজ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের ভবনে কখনও ছিল না।’
জানা গেছে, ইডেন ফিশারিজের নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতিঝিল শাখার অ্যাকাউন্টে ২০১৩ সালের ২ মে ১০টি চেকের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকা করে ৫ কোটি টাকা তোলেন আবদুল হাই বাচ্চু। একদিন পর উত্তোলন করেন আরও এক কোটি টাকা। একই দিন দু’জন ৫০ লাখ টাকা করে নগদ জমা দেন এক কোটি টাকা। এরপর ১৬ মে দুটি চেকের মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা তোলেন ইডেন ফিশারিজের মালিক বাচ্চু। আবার ওইদিনই দুটি চেকে ৫ কোটি টাকা জমা হয় একই অ্যাকাউন্টে। একদিনে ৯ কোটি টাকাসহ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ৩০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয় এই ব্যাংক হিসাবে। এমন খবরে বিস্মিত ব্যাংক ও অর্থনীতি খাতের বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এত স্বল্প সময়ে এত বড় অংকের টাকা ক্যাশে লেনদেন অস্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এ প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব ছিল। তিনি মনে করেন, দুদকের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
২০১৩ সালেই তখনকার চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সম্পৃক্ততায় হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ লোপাটের ঘটনা বহুদিন ধরে ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি।’ কিন্তু দিনের পর দিন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পরও বাচ্চুর অ্যাকাউন্টে রহস্যজনক লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক আমিনা জেসমিন রাজ্জাক বলেন, এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে পারব না। পাবলিকলি কথা বলার এখতিয়ার নেই। ব্যাংকের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগকে জানালে তারা বলতে পারবেন।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক যদি কোনো লেনদেনকে সন্দেহজনক মনে করে বা মনে করার কারণ থাকে এবং এরপরও এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রিপোর্ট না করে থাকে তাহলে সেটি অনৈতিক।১৩ ডিসেম্বর,২০১৭ বুধবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/প্রতিনিধি/আসাবি