সাদেকুর রহমান : বলা যায়, কেবল আনুষ্ঠানিকতা বাকি। দলে দলে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, পলায়ন এ অঞ্চলের মানুষকে দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বিজয়কে এক রকম নিশ্চিত করেছিল। মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ত্রয়োদশ দিবসে এমনি এক উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজিত ছিল এই ভূখন্ডে। সময়ের বিবর্তনে আজ বুধবার হলেও একাত্তরের এদিনটি ছিলো সোমবার। এই দিনে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়ে যায়।
এদিকে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী ঢাকার পতন দ্রুততর করার প্রয়োজনে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। কেন না ঢাকার পতন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পরাজয় চূড়ান্ত হবে। তবে এত দ্রুত যে ঢাকা আক্রমণ করা সম্ভব হবে এটা ধারণাতেও ছিল না ভারতীয় সৈন্যদের। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াইয়ের কারণেই যে এত দ্রুত মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে এগুতে পারছে এ কথা প্রত্যেক ভারতীয় সামরিক অফিসারই স্বীকার করেন। প্রশংসা করেন মুক্তিবাহিনীর।
একাত্তরের এই দিনে পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড এগিয়ে আসে পূর্ব দিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আসে জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড এবং টাঙ্গাইলে নামা ছত্রীসেনারা। পশ্চিমে ৪ নম্বর ডিভিশনও মধুমতী পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মার তীরে। রাত নয়টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে নয়টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউসে তারা পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন। আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।
আবদুল ওয়াহেদ তালুকদার তার ‘৭০ থেকে ৯০ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক গ্রন্থে একাত্তরের ১১ ডিসেম্বরের প্রধান প্রধান ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে, “(ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা) জেনারেল মানেকশ’ আজ (পাকিস্তানের) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছে মাইক্রোওয়েভে তৃতীয় বার্তা পাঠিয়েছেন। বার্তায় বলা হয়েছে যে, মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে ফেলেছে। আত্মসমর্পণ করা বাঞ্ছনীয় হবে। বৃথা আর রক্তপাত করে লাভ নেই। আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবস্থা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ একটা ব্যাপারে জরুরি নির্দেশ দিলেন। তা হচ্ছে, জনগণ যেনো নিজেদের হাতে আইন-শৃংখলার দায়িত্বভার গ্রহণ না করে। সমস্ত অপরাধীকেই বিচার করে শাস্তি দেয়া হবে।”
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থেও এদিনের ঘটনাবলীর একাংশ তুলে ধরা হয়- “মিত্রবাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগোচ্ছিল বিমান হামলা যতই বাড়ছিলো নিয়াজীর সাহায্য প্রার্থনা ততই বাড়ছিল। পিন্ডি এতদিন শুধু আশ্বাসই দিয়েছে, বাদামী এবং হলুদ বন্ধুদের আগমন সম্পর্কে তারা প্রায় নিশ্চিতই ছিল। বিশেষ করে ভিয়েতনামের দিকটি শেষ করে মালাক্কা ঘুরে এন্টারপ্রাইজ বহনকারী মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসে গেছে এতো সবাই জানে। ছুঁতা একটাই, বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে। সোভিয়েত হুমকি এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। যাই হোক, পারমাণবিক শক্তি চালিত বিমানবাহিনী এন্টারপ্রাইজ বাংলাদেশে আর নাক গলায়নি।”
বর্ণিত গ্রন্থে আরো উল্লেখ করা হয়, “ঢাকার পাক সেনাবাহিনী জানে পালাবার পথ নেই। বাংলাদেশে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বীরসিপাহীরা একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়লে বা সাধারণের হাতে পড়লে, এদের খতম করার জন্য কোনো অস্ত্রেরই প্রয়োজন হবে না, নিজেদের কুকীর্তি সম্পর্কে অন্তত ওদের ভালো জ্ঞান ছিল। পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রায় পনেরো মাইলের ব্যবধানে এসে গেছে। ৫৭ ডিভিশন পূর্ব দিকে আর উত্তর দিক থেকে গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড আর ছত্রীসেনা। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বৃষ্টির মতো ঝরছে। বিমান আক্রমণও খুব জোরে চলছে, উদ্দেশ্য হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়া। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাক সেনা আত্মসমর্পণ করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আত্মসমর্পণ করে ১১৩৪ জন।”
এদিন রামগতিতে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয় ঘটেছিল। ফেনী মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রামের উদ্দেশে কুমিল্লা পৌঁছেছিল দুপুর ১২টায়। চতুর্থ ও নবম বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে। সাত নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা হিলি থেকে বগুড়া হয়ে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। নাটোরের লালপুর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদী পার হয়ে এ সময় রাজশাহী আক্রমণ করেন। পরাজিত হয় পাকবাহিনী। তারা রাজশাহী ছেড়ে নাটোরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শেখপাড়া সাব- সেক্টরের মুক্তিবাহিনী পাবনা অভিমুখে এগিয়ে যায়। চার নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী সেদিন সিলেটের পথে হরিপুর মুক্ত করেছিল।
এদিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স আশঙ্কা করে বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শিগগিরই যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তিনি ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ চায় না। তবে যুদ্ধ বাঁধলে সে তাতে জড়িয়ে পড়বে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বললেও এই দিনই ২৪ ঘণ্টা থেমে থাকার পর বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে মার্কিন সপ্তম নৌবহর। একাত্তরের এই দিনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব তৃতীয়বারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেয়ার ফলে বাতিল হয়ে যায়।
এদিকে রাজধানী ঢাকাকে মুক্ত করতে জোর প্রচেষ্টা চলছিল। ডেমরার পর লে. কর্ণেল শফিউল্লাহর ‘এস ফোর্স’কে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত সেখানে যুদ্ধ চলে। একাত্তরের এই দিনে যৌথ বাহিনীর অগ্রবর্তী সেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার ৮-১০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়। বালু নদীর পূর্বদিকে পাকবাহিনী স্বীয় পরিসীমায় এক শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার চারদিকে আগে থেকেই পাকবাহিনী ফিল্ড ডিফেন্স বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নিয়েছিল।
অন্যদিকে, প্রকাশ্য ঘোষণা না দিলেও ১৩ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পাকিস্তানি অধিনায়ক লে. জেনারেল একে নিয়াজীসহ সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল পরদিন ১৪ ডিসেম্বর। সৈয়দপুরে এদিনে আত্মসমর্পণ করেন ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা।
একাত্তরে আজকের দিনে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা স্বাধীন পতাকা উড়ানো হয় বগুড়া জেলা শহর ও কাহালু উপজেলা, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, মানিকগঞ্জ শহর ও ধামরাই উপজেলা, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও নাটোরের লালপুরসহ আরো কয়েকটি জনপদে। হানাদারমুক্ত হওয়ায় ঘটনাগুলো প্রতি মুহূর্তেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকদের মনে উদ্যম ও শক্তি সঞ্চার করে।
১৩ ডিসেম্বর,২০১৭ বুধবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/ সংগ্রাম/আসাবি