টাকা পাচার থামছে না। বরং সুযোগ থাকায় পাচারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্ট অনুসারে ১০ বছরে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার ছয়গুণ বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এছাড়া সুইস ব্যাংক, পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স এবং মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের খবর আসছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ টাকা পাচার আরও বাড়ছে। কারণ দুর্নীতিবাজরা দেশ ছাড়ার আগে তাদের বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে নিয়ে যেতে মরিয়া। অথচ টাকা পাচার রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিশেষ করে অভিযোগ উঠেছে, ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইন ভয়েসের বাইরে এখন কোনো পণ্য না এনেই পুরো টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এছাড়া যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে বিদেশে অ্যাপার্টমেন্ট ও মার্কেট কেনাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন তাদের অনেকে চিহ্নিত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এভাবে অর্থ পাচারের পেছনে দুর্নীতি, গুরুতর অপরাধ, কর ফাঁকি এবং বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব অন্যতম কারণ। কিন্তু পাচার রোধে যেভাবে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তার ধারে কাছে কোনো উদ্যোগ নেই। তাদের মতে, পাচার বন্ধ করতে হলে সবার আগে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, যারা পাচার রোধ করবেন তাদের অনেকে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। অর্থাৎ শর্ষের মধ্যেই ভূত। এছাড়া এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এলসি ডকুমেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারের ডাটাবেজ ও পণ্য ছাড়করণ সংক্রান্ত কাস্টম ডকুমেন্ট যাচাই করা। এটি তৃতীয় কোনো সৎ ও সাহসী টিম দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ভালোভাবে যাচাই করা সম্ভব হলে বড় বড় রাঘববোয়াল চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, টাকা পাচারের কারণ সবার জানা। আর পাচার ঠেকানোর দায়িত্ব বেশি হল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। কিন্তু এখানেই বড় সমস্যা। শর্ষের মধ্যেই ভূত। এ প্রতিষ্ঠানটির একটি গোয়েন্দা সংস্থা আছে। কিন্তু সমস্যা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এদের নজরদারির জন্য আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা দরকার। এ অবস্থায় টাকা পাচার ঠেকানো মুশকিল। অন্যদিকে যত টাকা পাচারের তথ্য আসছে, তার সবই অবৈধ নয়। নানা কারণে বৈধ টাকাও বিদেশে পাচার হচ্ছে। তাই এসব অর্থ ঠেকানোর জন্য দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন অর্থ পাচারের বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। তার মতে, তিন কারণে বিদেশে টাকা পাচার হতে পারে। প্রথমত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কিছু লোক বিদেশে টাকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা পাচার হতে পারে। এছাড়া বিনিয়োগে মন্দা অবস্থা দূর না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের টাকা বিদেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যারা অর্থ পাচার করছেন তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে থেকে তারা এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার মতে, টাকা পাচারের মূল কারণ দুর্নীতি। আর অপরাধের বিচার না হলে অপরাধ বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, বিদেশে পণ্য লেনদেন হয়। সে অর্থ ফেরত আনা হয় না। অন্যদিকে ব্যবসার উদ্দেশে অনেকে টাকা নিয়ে যান। কিন্তু সেই অর্থ আর ফেরত আসে না। তার মতে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও দুদক এ চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে অর্থ পাচার রোধ করা সহজ হবে। কিন্তু ওই রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) এসেছে ১ হাজার ২৪৩ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা ৯৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আকারে যে পরিমাণ অর্থ আসছে, তার ৬ গুণের বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চলতি বছর প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বাড়ছে। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পানামা পেপার্স এবং প্যারাডাইস পেপার্সে বাংলাদেশিদের কর ফাঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া সরকারপন্থী কিছু শীর্ষ ব্যবসায়ীর মালয়েশিয়া, কানাডা এবং সিঙ্গাপুরে বড় অংকের টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।
টাকা পাচারের তথ্য এসেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির রিপোর্টে। এছাড়া জিএফআই ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের রিপোর্ট প্রকাশ করে এ বছর। রিপোর্টে দেয়া তথ্য অনুযায়ী এর সঙ্গে গত ৩ বছরের সময়কাল যুক্ত করলে টাকা পাচারের পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা হবে।
সূত্র বলছে, দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। ওই সব টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। নগদ অর্থ জমা রাখছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে আরও অনেক ব্যাংকে বাংলাদেশের টাকা পাচারকারীদের অর্থ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। ফলে যারা সেখানে সেকেন্ড হোম করেছেন তারা নির্ঘাত টাকা পাচার করেছেন।
সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে সই করায় বাংলাদেশ যেমন কালো টাকা উৎপাদনের সব পথ বন্ধ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, তেমনি যেখানে কালো টাকার সন্ধান পাওয়া যাবে সেখানেই অনুসন্ধান চালাতে হবে। দেশের প্রচলিত আইনি কাঠামোতে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
সুইস ব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশ্বে মূলত সাত কারণে টাকা পাচার হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল, ব্যাংকিং নীতি ও তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতা। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা দিতে না পারা। তৃতীয়ত, ব্যাংকিংয়ের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা। এছাড়াও রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাত্রাতিরিক্ত বিস্তার, পুঁজি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, বিদেশি ব্যাংকের বেশি উপস্থিতি এবং শেয়ারবাজার, বন্ড এবং ডেরিভেটিভস (এক ধরনের শেয়ার) মার্কেটের উন্নয়ন না করা। অর্থাৎ বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাওয়া।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, টাকা পাচার ঠেকাতে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যথেষ্ট তৎপর আছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দফতর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত দুটি বিষয় দেখে থাকে। আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে কিনা। এছাড়াও কেউ এলসি খুলে সমপরিমাণ অর্থের ঘোষিত পণ্য দেশে আনল কিনা তা পরীক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে গাইড লাইন দেয়া আছে। কি কি দেখে ব্যাংকগুলো এলসি করবে তা পরিষ্কার বলে দেয়া আছে। আর পাচারের বিষয়টি নজরদারি করার জন্য ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট নামে স্বতন্ত্র একটি সংস্থা আছে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারের আরও একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিটেন্স। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স একটি চক্র সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়। আর এদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় এর দায় শোধ করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। ওইগুলোও পাচার হয়ে বিদেশের কোনো ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো এবং রফতানিতে কম দেখানোর প্রবণতা রয়েছেই। এছাড়া এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী পণ্য রফতানি করে টাকা দেশে আনছেন না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশে কালো টাকার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। রাজনীতিবিদ, কিছু ব্যবসায়ী এবং আমলারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচার করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় দুর্নীতিবাজরা দেশে টাকা রাখছে না। দেশের দুর্যোগের সময় তারা যাতে আরও ভাল থাকতে পারে সেজন্য টাকা পাচার করে বিদেশে রাখছে। তিনি বলেন, এ অবৈধ কালো টাকার মাধ্যমে কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, টাকা পাচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীরব ভূমিকা গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সব সময় নিজেদের গা বাঁচিয়ে কথা বলেন। কারণ টাকা পাচার না হলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হল কিভাবে। শোনা যায়, কেউ কেউ বিদেশে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। তাই পাচার না হলে এত বিপুল অংকের টাকা দিয়ে এভাবে অ্যাপার্টমেন্ট ও মার্কেট কেনা সম্ভব হতো না।
জানা গেছে, বাইরের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কালো টাকার সঞ্চালন স্তিমিত হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এখন আর কালো টাকা রাখা যায় না। আগে ব্যাংকগুলোতে কালো টাকা রাখা যেত। বর্তমানে নিজের অ্যাকাউন্টে বেশি টাকা জমা দিতে গেলে আয়ের উৎস জানাতে হয়। এছাড়া এক অ্যাকাউন্টে অন্য কেউ টাকা জমা দিতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। ফলে কেউ ঝুঁকি নিয়ে টাকা দেশে রাখতে চান না।১৬ ডসিম্বের২০১৭,শনিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/যুগান্তর/আসাবি