ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: রয়টার্স/বিবিসি : জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার হাই কমিশনার জেইদ রেদ আল হুসেন বলেন, কোনদিন কোন আদালত যদি ‘গণহত্যার’ দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে তবে তিনি অবাক হবেন না। গতকাল সোমবার এক টিভি সাক্ষাতকারে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর সংঘটিত বর্বর হত্যাকা-ের সমালোচনা করে এই কথা বলেন জেইদ।
বিবিসিকে দেওয়া ওই সাক্ষাতকারে জেইদ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন পূর্ব পরিকল্পনার ফল।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে তা এককথায় ‘গণহত্যা’। ভবিষ্যতে এবিষয়ে কোন আদালত পদক্ষেপ নিলে আমি অবাক হবো না।’
যদিও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সর্ম্পকৃত সকল নৃশংসতাকে অস্বীকার করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতে, রাখাইন অঞ্চলে শুধুমাত্র বিদ্রোহদমন অভিযান চলেছে, কোন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। চলতি বছরের ২৫ আগষ্ট থেকে মিয়ানমারে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর নির্মম নির্যাতনের ফলে সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি শরনার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের এই বর্বরতাকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সম্পর্কে জেইদ শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা জিহাদি গ্রুপের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিয়ানমারে আক্রমণ করতে পারে। মিয়ানমারের বৌদ্ধ মন্দিরগুলো রয়েছে অন্যতম ঝুঁকিতে।’
বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়া সমঝোতায় স্বাক্ষর করলেও এখন নিধনযজ্ঞ থামেনি বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সমঝোতার পরও রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে ফেলার আলামত পেয়েছেন তারা। সোমবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে এমনটা জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে আংশিক বা পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৩৫৪টি গ্রাম। এখনও বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ছবিগুলো প্রমাণ করছে যে, এই ধ্বংসযজ্ঞ এমন সময়েও চালানো হয়েছে, যখন রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে মিয়ানমার।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতার পর রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে উল্লেখ করেছে। একে নিধনযজ্ঞ বলেছে যুক্তরাষ্ট্রও।
এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আরও ৪০টি গ্রামের ভবনসহ বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। এই সময়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
সংস্থাটি জানায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত দুইমাসে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ পেয়েছে তারা। ২৩শে নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়। তবে ২৫শে নভেম্বর রাখাইনের মংডুর কাছে মিয়াও মি চ্যাঙ গ্রামে আগুন আর ঘরবাড়ি ধ্বংসের ছবি তুলেছে স্যাটেলাইট। পরের এক সপ্তাহের মধ্যে চারটি গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
সংস্থাটির এশিয়ার বিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলছেন, “সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরের সময়েও রাখাইন গ্রামে বার্মার সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো থেকে এটাই প্রমাণ হয়, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার এই প্রতিশ্রুতি স্রেফ একটি প্রচারণা। রোহিঙ্গা গ্রামগুলো ধ্বংসের যেসব অভিযোগ বার্মার সেনাবাহিনী অস্বীকার করে আসছে, সেটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে এসব স্যাটেলাইট ছবি।”
মিয়ানমারের মংডু, বুথিডাং আর রাথিডাং শহরে আশেপাশের ১০০০ গ্রামের উপর স্যাটেলাইটের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেছে এসব তথ্য পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ বছর অগাস্ট মাসের শেষের দিকে রাখাইনে সামরিক অভিযান শুরুর পর এসব গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫৪টি গ্রামের মধ্যে অন্তত ১১৮টি গ্রামে হামলা হয়েছে ৫ই সেপ্টেম্বরের পর, যখন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিস থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, রাখাইনে অভিযানের সমাপ্তি হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, আগস্ট থেকে রাখাইনে শুরু করা এই অভিযানের সময় বার্মার সেনাবাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, গ্রেপ্তার আর ব্যাপক অগ্নিকা- চালিয়েছে। জাতিগত নির্মূলের এই অভিযান মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গেই সমতুল্য বলে সংস্থাটি দেখতে পেয়েছে।
গত ১৪ই ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান মেদসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ে (এমএসএফ) বলছে, মিয়ানমারে আগস্টে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর এক মাসে অন্তত ৬ হাজার ৭’শ রোহিঙ্গা হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৬ হাজার ৭’শ মৃত্যুর কারণ সহিংসতা, যার মধ্যে পাঁচ অথবা তার চেয়ে কম বয়সের শিশু ছিল ৭৩০ জন।
১৯ডিসেম্বর,২০১৭,মঙ্গলবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/ রয়টার্স/আসাবি