শালতা নদী এখন লাখো মানুষের বেঁচে থাকার অভিশাপ

আকবর হোসেন তালা থেকে :   আমি পাঁচবার শালতা খনন নিয়ে সংসদে উত্থাপন করেছি কিন্তু  তার কোন গুরুত্ব আসেনি। সংসদ সদস্য এ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ জানান, সদস্য এ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ জানান, নদীর নাম শালতা। এক পাড়ে সাতক্ষীরা তালা উপজেলার কাঠবুনিয়া, আরেক পাড়ে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রাম। মাঝদিয়ে বয়ে গেছে এক সময়ের খরস্রোতা এই নদী। একাংশ বুড়িভদ্রার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং অপর অংশ শিবসা নদীর সাথে। এরমধ্যে ১৬, ১৭/১ নং পোল্ডারের আওতাধীন ১৮ কিলোমিটার নদী একেবারেই মরে গেছে । কিছু অংশ মিশে হয়েছে সমতল ভূমি আর সেখানে উঠেছে বাড়িঘর, অন্যান্য অবৈধ্য স্থাপনা। যেখানে নিচু সেখানে বাঁধদিয়ে এক শ্রেনীর মানুষ করেছে চিংড়ির ঘের। যে নদী সচল রেখেছিল মানুষের জীবন, মৎস্যজীবীদের জীবিকা নির্বাহ, গ্রামে ছিলো প্রাণচাঞ্চল্য, সবজী মৌসুমে নদী থেকে পানি সেচ দিয়ে ফলাতো কাঁচা সবজী সহ বিভিন্ন ফসলাদী। মানুষকে দিয়েছিল কাজের সন্ধান, সেই নদী এখন লাখো মানুষের বেঁচে থাকার অভিশাপ।
শালতা তীরবর্তী তালা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রাম সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে অনেক অজানা তথ্য। কপোতাক্ষ ভরাটের পর তালা উপজেলার খলিলনগর, তালা সদর, তেঁতুলিয়া এবং ইসলামকাটী ইউনিয়নের ৪০ টি গ্রামের কমপক্ষে ১লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে দিন কাটােচ্ছ বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কাঠবুনিয়া, বৈটেয়ারা, বাটুলতলা, মহান্দী, নলতা, খলিলনগর, মাছিয়াড়া, বয়ারশিং, মুড়োবুনিয়া, পুটিমারী ও সুন্দরবুনিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ অভিযোগ করে বলেন, সংশ্লিষ্ঠ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলাতী এবং নদী ভরাটের জায়গা ইজারা দেওয়ার কারনে আজ এলাকা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। নদী ভরাট হওয়ায় তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তাই শালতা নদী খনন লাখ লাখ মানুষের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। সম্প্রতি শালতা বাঁচাও কমিটির আয়োজনে এবং বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ ও পানি কমিটির সহযোগিতায় শালতা নদী পুনর্জীবনের লক্ষ্যে নদী অববাহিকার ভুক্তভোগী মানুষ ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে দফায় দফায় চলছে বৈঠক। শালতা মরে যাওয়ায় এলাকায় বর্ষার ছয়মাস জলাবদ্ধতা দেখায়ায় এসময় মানুষের কোন কাজ থাকে না। রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, যাতায়াত ব্যবস্থা অসহনীয়। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা হুমকি হয়ে দাড়ায়। চিকিৎসা সেবায় চরম সংকট দেখা দেয় । এসময় কোন মারাত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়লে রাস্তাঘাট অচল থাকায় অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শালতা পূর্ণখনন হলে এলকার মানুষ যেমন জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাবে, তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়বে । এলাকা ছেড়ে বাহিরে পাড়ি জমাতে হবে না সংসার পরিচালনার জন্য। তাই এলাকার মানুষের এই মুহুত্বে হাহাকার, অনতিবিলম্বে শালতা খনন করে লাখো মানুষের জীবন বাঁচানো দরকার।
এলাকাবাসীর প্রাণের দাবী, শালতা নদী খননের আগে সীমানা নির্ধারণ করা জরুরী। অনেকস্থানে নদীর চিহ্নমাত্র নেই। কেউ কেউ একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে ভরাট নদীর বুকে বাড়িঘর তুলেছে, মাছের ঘের করেছে। খননের আগে সীমানা নির্ধারণ করা এবং সকল অবৈধ্য স্থাপনা উচ্ছেদ করা না হলে ব্যাপক সংঘাতের আশংকা দেখা দেবে। সরকারি ম্যাপে এই নদীর চওড়া কোথাও ৪৫০ ফুট, কোথাও ৫০০ ফুট আবার কোথাও ৪০০ ফুট।
ডুমুরিয়া উপজেলার বৈটেয়ারা গ্রামের বাসিন্দা দিপংঙ্কর মন্ডল (৫২) জনান, শালতা নদীর বুকে ভেসে গেছে এক সময় বহু ঘর-বাড়ী কখনও কখনও ভেসে গেছে অনেকের জীবন। আর এখন সেই শালতার বুকে ঘের, বসতবাড়ী। ২০/২২ বছর আগের অনন্ত ৫০০ ফুট চওড়া নদীটি এখন একেবারেই মরে কিছু কিছু এলাকায় নিশানাহীন হয়ে পড়েছে। নদীর বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এটি সেই খরেস্রাত শালতা নদী। এক সময় এই নদীতে লঞ্চ, স্টীমার চলতো কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন সে দিন মানুষ মটরসাইকেল, ভ্যান চালিয়ে পার হয়। আর এই নদী ভরাট হওয়ায় দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।
তালা উপজেলার হাজরাকাটী গ্রামের সুভাষ ঘোষ বলেন, নদীর নাব্যতা থাকাকালে বিলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ধান হত। হরকোজ ধান, বালাম ধান, পাটনাই ধান’র খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। সে সব ধান আজ হারিয়ে গেছে। যেসব মানুষ কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা এখন বেকার। কিছু মানুষ মাছের ঘেরে কাজ করতে পারলেও অনেকেই রোজগারের প্রয়োজনে এলাকার বাইরে ইট ভাটায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
শালতা বাঁচাও কমিটির সভাপতি সাবেক খলিলনগন ইউপি চেয়ারম্যান সরদার ইমান আলী জানান, ইতিমধ্যে জোয়ার-ভাটা না থাকার কারণে পলি পড়ে শালতাও ভরাট হয়ে গেছে। শালতা খনন এখন এই এলাকার মরনব্যাধি। দ্রুত খনন না করলে এলাকার মৎস্যজীবীসহ জীব বৈচিত্র ফিরে পাবে।
এব্যাপারে খলিলনগন, তালা, তেঁতুলিয়া, কপিলমুনি, মাগুরাঘোনা, আঠুলিয়া, মাগুরখালী, লতা ইউপি চেয়ারম্যান জানান, শালতা খনন এখন মানুষের প্রাণের দাবী। শালতা খনন হলে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে এবং জেলে সম্প্রদায় তাদের জীবন জীবিকা ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি চলাচলের ঝুকি মুক্ত হবে সর্বস্তরের মানুষ।
সাতক্ষীরা জেলা আ’লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক প্রণব ঘোষ বাবলু জানান, শালতা খনন হলে পাইকগাছা, তালা, ডুমুরিয়া উপজেলার ৪০টি গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে। এবং জেলে সম্প্রদায় তাদের জীবন জীবিকা ফিরে পাবে। শালতা তীরবর্তী বিলে ধান ও মৎস্যচাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।
তালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার জানান,শালতা খনন করা খুবইয় জরূরী । মাননীয় প্রধান মন্ত্রী চাইলে শালতা খনন করতে পারেন। শালতা খনন হলে এলাকার জলাবদ্ধতা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে।
সাতক্ষীরা-১(তালা-কলারোয়া) সংসদ সদস্য এ্যড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ জানান, আমি পাঁচবার শালতা খনন নিয়ে সংসদে উত্থাপন করেছি কিন্তু তার কোন গুরুত্ব আসেনি। কারণ শালতার যে অংশটি খনন হবে তার বেশির ভাগ ডুমুরিয়া উপজেলার ভিতরে তাই ঐ এলাকার স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি বিয়টি বিবেচনা করেন তাহলে সম্ভাবনা আছে। গত ১০ ডিসেম্বর আবারও একটি ডিও লিটার দিয়েছি শালতা খননের জন্য।
বর্তমান শালতার সংকটে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী (যশোর অঞ্চল) প্রবীর গোস্বামীকে একাধিকবার তার মোবাইলে ফোনদিলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

২০ডিসেম্বর২০১৭,বুধবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/প্রতিনিধি/আসাবি

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।