ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: ভারতে বসবাসরত অবৈধ ‘বাংলাদেশি’ ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে বলে আউটলুক পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
পত্রিকাটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বহুদিন ধরেই অবৈধ ‘বাংলাদেশি’দের ইস্যুটি ঝুলে আছে। যেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল বিষয়ই হলো এটা। ভারতে মাঝে-মধ্যেই এটা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরী হয়েছে। কিন্তু ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে ভেতরে ভেতরে যতই হৈ চৈ হোক, দ্বি-পাক্ষিক ইস্যু হিসেবে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি আজ অব্দি আনুষ্ঠানিক কোন ইন্দো-বাংলাদেশ বৈঠকে আলোচনায় আসেনি, বিশেষ করে শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনায় তো উল্লেখই হয়নি।
এর একটা বড় কারণ হলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। বিশেষ করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত ১০ বছরে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নয়াদিল্লির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছে।
মনমোহন সিংয়ের দুই মেয়াদের ইউপিএ সরকার এবং তার উত্তরসূরী নরেন্দ্র মোদির এনডিএ সরকার- দুই শাসনামলেই ঢাকার সাথে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাস্তবে ঢাকার ব্যাপারে তাদের নীতিকে আলাদা করে দেখাই মুশকিল। গত দশকে দুই পক্ষই তাদের সম্পর্ক উন্নয়নের সবরকম চেষ্টাই চালিয়ে গেছে। সে কারণেই বিতর্কিত ইস্যুগুলো সবসময় আলোচনার টেবিল থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
তবে, আসামে যখন ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্সের’ খসড়া প্রায় চুড়ান্ত হওয়ার পথে, তখন অবৈধ অভিবাসী প্রসঙ্গটি এড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। এ প্রেক্ষিতেই বলা যায় খুবই স্পর্শকাতর একটা দায়িত্ব এখন মোদি সরকারের সামনে। দেশের মানুষদের মনোতুষ্টির পাশাপাশি ঢাকার সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যাতে কোনভাবেই নষ্ট না হয়, সেভাবে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পথ তাদের বের করতে হবে।
বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত রয়েছে ভারতের। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের দৈর্ঘ ৪,০৯৬ কিলোমিটার। প্রায় কয়েক দশক ধরে অভিবাসী ইস্যু আসামের সাথে বিরোধ তৈরী করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আসামের সাথে বাংলাদেশের সীমানা খুবই সামান্য। বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত রয়েছে, এ রকম পাঁচটি রাজ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ (২,২১৭ কিলোমিটার), ত্রিপুরা (৮৫৬ কিলোমিটার), মেঘালয় (৪৪৩ কিলোমিটার), আসাম (২৬২ কিলোমিটার) এবং মিজোরাম (১৮০ কিলোমিটার)।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘আসামে কি হচ্ছে, সে ব্যাপারে তারা সচেতন রয়েছেন’। কিন্তু দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার কোন চেষ্টা হয়নি। একই সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে এটা উপস্থাপনের আগ পর্যন্ত আসলে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের কিছু বলার ছিল না। তবে এনআরসি খসড়া হয়তো একটা কলহ তৈরী করবে। কারণ প্রাথমিকভাবে এর অধীনে ‘বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসীদের’ চিহ্নিত করা হবে। তখন আসবে পরবর্তী পদক্ষেপের প্রসঙ্গ তাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি। বলা সহজ, কিন্তু এতে দিল্লি-ঢাকার সম্পর্কের ক্ষতি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বললেন, ‘যখন সামনে ব্রিজ আসবে, তখন এটা পার হওয়ার চিন্তা করবো আমরা। তবে সন্দেহ নেই, এটা একটা প্রধান ইস্যু হতে চলেছে।’
ভারতের কর্মকর্তারা অনেকটাই গম্ভীর হয়ে আছেন। তারা বলছেন, বিষয়টা হয়তো প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রধান জায়গাগুলোতে আলোচনায় আসেনি, কিন্তু কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে অভিবাসন ইস্যুটি উঠেছে এবং সাম্প্রতিককালে এ বিষয়টিতে আলোচনার মাত্রাও বেড়েছে।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, ভারতে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি না থাকায় এটা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানোয়াল সিবাল বলেন, ‘ভারতে অবৈধ বাংলাদেশীর উপস্থিতি অস্বীকার করার একটা প্রবণতা বাংলাদেশের রয়েছে।’ দায়িত্বে থাকাকালে সিবাল এ ধরণের বহু আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
সিবাল এটাও বললেন, বাংলাদেশ যদি স্বীকারও করে যে ভারতে কিছু বাংলাদেশি অবৈধভাবে অবস্থান করছে, তবু তাদের পরিচয় যাচাইয়ের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া হবে অনেক দীর্ঘ। আর এ ব্যাপারে ভারতের বক্তব্যের সাথে তাদের দ্বিমতও হবে অবশ্যম্ভাবী। ভারত যাদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করবে, বাংলাদেশ তাদের নিজের অধিবাসী হিসেবে স্বীকার করবে না।
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব মনে করেন, বাংলাদেশের উচিত ‘অবৈধ অভিবাসী’ সমস্যাটি সততার সাথে স্বীকার করা এবং সমস্যার সমাধানে ভারতের সাথে সহযোগীতা করা। কিন্তু ভারত কি এখন বাংলাদেশের কাছে এই বিষয়টি উত্থাপনের পর্যায়ে আছে?
আগামী বছরের শেষ নাগাদ, সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় এ বিষয়ে নমনীয় মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা ঢাকার জন্য সহজ হবে না। প্রধান বিরোধী দল খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) হাসিনাকে ভারতপন্থী হিসেবে অভিহিত করে এবং তিস্তার পানি চুক্তি করতে ব্যর্থতার জন্য তার সমালোচনা করে আসছে। আওয়ামী লীগও অসন্তুষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনের নামে তারা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশ যখন প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তখন শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারকে কোন প্রকার চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। উল্টো ভারতের মধ্য অবস্থানরত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের কথিত যোগাযোগ নিয়ে ভারত যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী বিষয়টির উত্থাপন শুধু বিরক্তিই বাড়াবে।
নয়াদিল্লি যদি এটা নিয়ে বেশি চাপাচাপির চেষ্টা করে, তবে তা হাসিনার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা আরো নষ্ট করে দিবে। তখন ক্ষমতায় আসবে বিএনপি ও তাদের ইসলামী মিত্র দলগুলো, যারা দিল্লির জন্য আরও মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কিন্তু, সামনের মাসগুলোতে ভারতও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এ রকম অবস্থায় অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী এলাকা না কি ঢাকার সাথে মিত্রতা, কোনটিকে গুরুত্ব দিবেন মোদি, তা নিয়ে বাজি ধরার কোন অবকাশ থাকে না।
Check Also
আসিফ নজরুলকে হেনস্তা, চাকরি হারাচ্ছেন স্টাফ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরের সামনে …