‘রাখা হতো টয়লেটে পেটানো হতো অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত’ একবেলা জুটত পচা খাবার, ভুল হলেই মারধর * নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ পেত গৃহকর্ত্রী-গৃহকর্তা * আড়াই লাখ টাকায় ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:‘কিশোর গৃহকর্মী আল আমিনের কাজে একটু ভুল হলেই মাথায় তুলে আছাড় মারা হতো। অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত তাকে পেটানো হতো। এরপর টয়লেটে ফেলে রাখা হতো। জ্ঞান ফিরলে একবেলা জুটত পচা খাবার।’ সোমবার ১৬৪ ধারায় আদালতে আসামিদের দেয়া জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

রাজধানীর আদাবরের শেখেরটেকের (রোড নম্বর ৪, বাসা নম্বর ২৩/২৫) একটি বাসায় গৃহকর্মী আল আমিনের (১২) ওপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা চলত। তাকে নির্যাতন করে গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তা পৈশাচিক আনন্দ পেত। টানা ছয় মাস ধরে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। খেতে না পেয়ে তার শরীর হয়ে ওঠে কঙ্কালসার।

নির্যাতন করেও সাধ মেটেনি তাদের। রোববার ঘাড় মটকে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা গৃহকর্তা শেখ জোবায়ের আলম ও গৃহকর্ত্রী সাইয়্যেদা রহমান আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনায় জোবায়ের, তার স্ত্রী সাইয়্যেদা, শাশুড়ি আনজু আরা পারভীন ও শ্যালক সাকিব আহমেদকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ঘটনার দায় স্বীকার করে জোবায়ের ও সাইয়্যেদা সোমবার ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।

আল আমিনের চাচা হারুন অর রশীদ জানান, ময়মনসিংহের বাঘাডুবার শিমুলিয়াপাড়ার দরিদ্র কৃষক রুহুল আমিনের চার সন্তানের মধ্যে বড় আল আমিন। অভাবের তাড়নায় ঢাকার এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজে তাকে দিয়েছিলেন তার বাবা। ছয় মাস ধরে তাকে এমন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার পরিবার।

আদাবর থানার অপারেশন অফিসার সুজিত সাহা যুগান্তরকে বলেন, আল আমিনের শরীরের সর্বত্র ক্ষতচিহ্ন ছিল। তাকে দেখে মনে হয়েছে একটি কঙ্কালের ওপর চামড়া লাগিয়ে রাখা হয়েছে। এই কঙ্কালসার দেহের ওপর এমন অত্যাচার কল্পনাও করা যায় না। পেশাগত জীবনে এমন নির্মম নির্যাতনের ঘটনা শোনেননি তিনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ছয় মাস আগে জোবায়ের ও সাইয়্যেদা দম্পতির জন্ম নেয়া সন্তানের দেখাশোনা করার জন্য আল আমিনকে নেয়া হয়। আল আমিনের চাচাতো ভাই মানিক মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মী হিসেবে তাকে ওই বাসায় কাজে দেন। এরপর আল আমিনকে একটিবারের জন্যও ওই বাসা থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। এমনকি পরিবারের সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতেও দেয়া হয়নি।

কাজে ভুল করার অজুহাতে দিনভর সাইয়্যেদা তাকে নির্মম নির্যাতন করত। কখনও তিনি স্কেল দিয়ে, আবার কখনও লোহার রড দিয়ে আল আমিনকে পেটাতেন। গার্মেন্টস এক্সেসরিজের ব্যবসায়ী জোবায়ের ফিরলে সাইয়্যেদা নানা অভিযোগ দিতেন আল আমিনের নামে। স্ত্রীকে খুশি রাখতে তিনি কখনও রড দিয়ে আল আমিনকে পিটিয়ে অজ্ঞান করে টয়লেটে রেখে আসতেন। কখনও আছাড় মারতেন। এসব দেখে তার স্ত্রী পৈশাচিক আনন্দ পেতেন।

তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মনিরুজ্জামান মনি  বলেন, তিন মাস আগে আল আমিনের ডায়রিয়া হয়। তখন তাকে টয়লেটে থাকার স্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়। রাত ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত তাকে টয়লেটে থাকতে হতো। গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী ঘুম থেকে উঠলে আল আমিন টয়লেট পরিষ্কার ও গোসল করে সেখান থেকে বের হওয়ার অনুমতি পেত। সারাদিন কাজ করে রাতে একবেলা তার পচা খাবার মিলত।

আল আমিনকে যেভাবে হত্যা করা হয় : তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শনিবার সকালে কাজে ভুল করার অজুহাতে আল আমিনকে একদফা রড দিয়ে পেটান সাইয়্যেদা। সন্ধ্যার পর জোবায়ের বাসায় বাজার নিয়ে এলে সেগুলো গুছিয়ে রাখতে আল আমিনকে বলা হয়। শরীর অসুস্থ থাকায় সে গুছানোর কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন জোবায়ের ও সাইয়্যেদা তাকে পেটায়। রাত ৮টার দিকে বাচ্চার দুধের ফিডার হাত থেকে পড়ে গেলে সাইয়্যেদা চিৎকার শুরু করে। জোবায়ের স্ত্রীকে খুশি করতে আল আমিনকে মাথায় তুলে ছুড়ে মারে। এতে তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে।

ওই অবস্থায় তাকে আবারও পেটায় জোবায়ের। আল আমিন অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে টয়লেটে রেখে আসা হয়। তাকে পানির ট্যাবের নিচে রেখে সেটি চালু করে দেয়া হয়। এক ঘণ্টা পর সেটি বন্ধ করা হয়। রাত ১টার দিকে সাইয়্যেদা টয়লেটে গিয়ে দেখে আল আমিন ওই অবস্থায়ই শুয়ে আছে।

তাকে অনেকবার ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে সে প্রচণ্ড রেগে যায়। সে তার ঘাড়ে জোরে লাথি মারে। এতে আল আমিন টয়লেটের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছিটকে পড়ে। পরে টয়লেটের দরজা লাগিয়ে সাইয়্যেদা ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন রোববার সকাল ৭টার দিকে সাইয়্যেদার মা আনজু আরা টয়লেটের দরজা খুলে দেখেন আল আমিন ওই অবস্থাতেই মেঝেতে পড়ে আছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা। তখন তিনি জোবায়ের ও সাইয়্যেদাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। জোবায়ের স্থানীয় একটি ওষুধের দোকান থেকে একজনকে নিয়ে আসেন। পরীক্ষা করে তিনি জানান, আল আমিন মারা গেছে।

মোবাইল ফোনে আল আমিনের পরিবারকে জোবায়ের জানান, আল আমিন গুরুতর অসুস্থ। রোববার সন্ধ্যায় তার চাচা হারুন ও অন্য আত্মীয়স্বজনরা এসে তার লাশ দেখতে পায়। সে সময় জোবায়ের আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে আদাবর থানা পুলিশ রাতে লাশ উদ্ধার করে। ওই রাতে হারুন আদাবর থানায় হত্যা মামলা করেন। ২৭ ডিসেম্বর,২০১৭ বুধবার:ক্রাইমর্বাতা.কম/যুগান্তর/আসাবি

Check Also

ভোমরা সীমান্ত থেকে ১০পিস সোনার চকলেটসহ আটক-১

নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তের ফলমোড় এলাকা থেকে ১০পিস সোনার চকলেটসহ সুমন ইসলাম নামের এক কিশোরকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।