ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট:স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনে আসছে পশ্চিমাদের নতুন বর্ষ ২০১৮। ২০১৭-র ঘটবে স্বাভাবিক পরিণতি। অর্থাৎ আমাদের জীবন থেকে বিদায় নেবে ২০১৭। রেখে যাবে অনেক স্মৃতি। সে স্মৃতি আনন্দ-বেদনার, পাওয়া-না-পাওয়ার এবং আশা-নিরাশার সংমিশ্রণ। অনেক আকাক্সক্ষার অপূর্ণতার সে স্মৃতি। তাই নতুন বছরের শুরুতে সবারই কামনা অপূর্ণ বিষয়গুলো পূর্ণতা পাবে নতুন বছরে।
ইতোমধ্যে পৃথিবী বদলেছে অনেকখানি। বদলাচ্ছে। আরো বদলাবে। কিন্তু এর মাঝেও অনেকেই চাইবেন বদলানো বিষয়গুলো নিয়ে আসুক নতুন বার্তা। নিয়ে আসুক সুবাতাস। যেন সে বার্তা, সে বাতাস আমাদের সকলের জীবনে নতুন অনুভূতি জাগাতে সক্ষম হয়। যেন সে বাতাস আমাদের বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনে বাঙালিয়ানা ফিরে আনে ষোল আনা। যেমনটি চেয়েছিলেন বাঙালি শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয়নুল আবেদিন। পোশাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, চালচলন, কথাবার্তা, খাওয়াদাওয়া এবং শিল্প সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে বাঙালিআনার ষোলআনাই চেয়েছিলেন শিল্পীদ্বয় নিজের জীবনে এবং আমাদের জীবনে। কিন্তু এই মহান দুই শিল্পীর চাওয়া ষোলআনা পূর্ণ হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। সুতরাং আমাদের কামনা নতুন বছর ২০১৮ বাঙালি সংস্কৃতির ষোলআনা পূর্ণ করার নতুন বার্তা নিয়ে আসবে। পূর্ণ করবে মহান শিল্পীদ্বয়ের আকাক্সক্ষাকে। প্রতিষ্ঠা পাবে বাঙালির নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি। যার অনেকটাই ধ্বংস করেছে ধূর্ত ইংরেজ শাসকরা। তারা চেয়েছে তাদের পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পাক বাঙালির জীবনে। ধ্বংস হোক বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব শিল্পরীতি। ইংরেজদের এ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করেছে বাঙালিদেরই একটি বড় অংশ। নিজের শিল্প-সংস্কৃতি ভুলে বিদেশী পশ্চিমা শিল্প সংস্কৃতিকে নিয়েছে আপন করে। চলনে বলনে, খাওয়া দাওয়ায়, পোশাকে ও কাজকর্মে এসেছে পরিবর্তন। মানুষ ভুলতে বসেছে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিকে। নিজস্ব শিল্পরীতিকে। তাইতো ঘটা করে পয়লা বৈশাখে এবং চৈত্রসংক্রান্তিতে বাঙালিপনার বিষয়কে স্মরণ করতে হয়। বাঙালি সাজার রিহার্সাল দিতে হয়। এভাবে যারা এক দিনে বাঙালি সাজার চেষ্টা করে তারা মনে প্রাণে বাঙালি নয়। এক দিন বা দুই দিনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালি হওয়া যায় না। বিষয়টি হৃদয়ে অনুভব করতে হয়। মনপ্রাণ দিয়ে বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে ভালো করতে হয়। যেমনটি অনুভব করেছিলেন এবং ভালোবেশে ছিলেন ভারতের তথা পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি স্বদেশী শিল্প চর্চা করতে করতে বিষয়গুলো অনুভব করে বলেছিলেন যে, ‘যখন আমাদের ভারত শিল্পের জোর চর্চা চলছে, তখন ভাবলুম, শুধু ছবিতে নয়, সব দিকেই এর চর্চা করতে হবে। লাগলুম আসবাবের দিকে, ঘর সাজাতে, আশপাশে চারদিকে ভারত শিল্পের আবহাওয়া আনতে। মনোজিৎ বসু, অবনীন্দ্রনাথ, মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা, পৃ.২৭)। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এ বক্তব্যকে বাস্তবায়ন করতে তিনি তার বাড়ির চেয়ার, টেবিল, পরদা, ফুলদানিসহ যত বিদেশী আসবাবপত্র ছিল তার সবই বিক্রি করে দেশী আসবাবপত্রের সাহায্যে ঘরবাড়ি সাজিয়েছিলেন! ফলে তার বাড়িতে বিলেতি কোনো কিছুই আর দেখা যায়নি।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতানসহ অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশের জনজীবন এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কথা। যে কারণে তারা তাদের ক্যানভাসে বাংলা, বাঙালি এবং তাদের জীবনকে, তাদের সংস্কৃতিকে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু এদের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের ক্যানভাসে বাংলাদেশ নেই। আছে পশ্চিমা ধারার বিষয়হীন কিংবা আধা বিমূর্ত ধারার বিষয়। যারা পশ্চিমের বিমূর্ত আধাবিমূর্ত ধারার অনুসারী তারা প্রথম জীবনে বাস্তব ভিত্তিক কাজ করলেও বিদেশ থেকে পশ্চিমা ধারায় শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে পশ্চিমা ধারাতেই চর্চা করে চলেছেন। এই বিজাতীয় ধারা কেউ কেউ পছন্দ করলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠী পছন্দ করেন না। তারা আশা করেন শিল্পী নিজ দেশের সমাজ জীবনকে ক্যানভাসে তুলে ধরবেন। যাতে দেশের এবং বিদেশের মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। শিল্পী অঙ্কিত চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারে।
বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। শিল্পীর ক্যানভাসে মুসলিম সমাজ, সমাজের মানুষ এবং মানুষের ক্রিয়াকর্ম এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো নানাভাবে স্থান পাওয়ার কথা। কিন্তু মুসলিম সমাজের কোনো কিছুই শিল্পীর ক্যানভাসে নেই। অথচ ভারতের প্রায় শতভাগ শিল্পীর ক্যানভাসে হিন্দু সমাজ এবং হিন্দুধর্ম বিষয়ক সব সময় স্থান পেয়েছে এবং পাচ্ছে। তার পরও কোেেনা শিল্পী কিংবা শিল্পী গোষ্ঠী যখন পশ্চিমের মডার্নিজম কিংবা পোস্ট মডার্নিজমের চর্চা করেন তখন ভারতপন্থী শিল্পী এবং সমালোচকদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করতে দেখা যায়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই বোধ হয় একমাত্র ব্যতিক্রম যে দেশের শিল্পী কিংবা সমালোচকদের কাউকেই নিন্দা কিংবা সমালোচনা করতে দেখা যায় না। বরং পশ্চিমা ধার করা ধারার পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা যায়! একমাত্র শিল্পী কামরুল হাসান একবার অত্যন্ত দুর্বল স্বরে পত্রিকায় প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তার এই প্রতিবাদের পক্ষে সমর্থন দেননি কেউ।
ভারতে অসংখ্য সংগঠন রয়েছে শিল্পীদের। যারা সংগঠনের মাধ্যমে নানা কর্মকাণ্ড করে থাকেন। সংগঠনে সংগঠনে চলে প্রতিযোগিতা। কারা কতটা ভারতপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্প চর্চা করতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলে। কোনো সংগঠন ভারতের আদর্শ বিরোধী কর্ম করলে তার সমালোচনা করে। ভারতে রয়েছেন অসংখ্য শিক্ষিত শিল্প সমালোচক। তারা প্রতিনিয়ত শিল্পের এবং শিল্পীর ভুলভ্রান্তি এবং সফলতা নিয়ে নির্মহভাবে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে। ফলে যার যা খুশি করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ভারতে খ্যাতিমান শিল্পীরাও তাদের ভুল ভ্রান্তির জন্য কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন। ফলে ভারতের শিল্পীদের ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। জাপানের দিকে দৃষ্টি ফেরালেও দেখা যাবে সে দেশের শিল্পীদের মাঝে জাতীয়তাবোধ কাজ করে প্রবলভাবে। সে দেশের শিল্পীরা শিল্পকর্মের মাধ্যমে জাপান, জাপানের জনগণ এবং তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে সদা তৎপর। কখনো কখনো পশ্চিমা শিল্প ধারা দ্বারা কোনো কোনো শিল্পী প্রভাবিত হলেও সেই ধারা বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
একবার সরকারিভাবে জাপানে পশ্চিমা ধারা আমদানি করার প্রচেষ্টা শুরু হলে শিল্পী এবং সমালোচকরা প্রবলভাবে সরকারের বিরোধিতা করেছিল। ফলে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। জাপানি শিল্পীদের দেশপ্রেম হয় বিজয়ী। দেশপ্রেমকে কোনো কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে পূর্বে সহযোগিতা দিয়েছিলেন বলেই পশ্চিমা ধারা জনপ্রিয় হতে পারেনি জাপানে। দেশপ্রেমের কারণেই শিল্পীরা মনে করতেন- পশ্চিমা ধারার কাজ যত ভালোই, হোক, যত প্রশংসিতই হোক, যত পুরস্কারই পাকনা কেন প্রকৃত অর্থে এ ধরনের কাজে জাপান একেবারেই অনুপস্থিত। সুতরাং জাপানের নাম-গন্ধহীন, জাপানের সংস্কৃতিবিহীন অ্যাবস্ট্রাক্ট বা ওই ধারার শিল্প চর্চা করা আর পশ্চিমকে অন্ধ অনুকরণ করার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। তারা মনে করেছেন- পশ্চিমা শিল্প অন্তঃসারশূন্য। এ জন্য জাপানের নিজস্ব সংস্কৃতি ও রীতির প্রতি অনুগত শিল্পী সমাজ।
চীনের দিকে দৃষ্টি ফেরালেও দেখা যাবে সেখানকার শিল্পীরাও অত্যন্ত দেশপ্রেমী। তারা নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ধর্মকে ভোলেনি। এ কারণে চীনের জনজীবন, ধর্ম এবং প্রকৃতি শিল্পীদের ক্যানভাসে স্থান পেয়েছে। স্থান পেয়েছে ধর্মীয় গুরু গৌতম বুদ্ধ, বুদ্ধের অনুসারী ধর্মীয় গুরু এবং রাজাদের কর্মকাণ্ড। কোরিয়ার জনগণও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। এ জন্য কোরিয়ার শিল্পীদের ক্যানভাসেও ধর্ম এবং রাজাদের কর্মকাণ্ড প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্মীয় চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে শিল্পী কিম মায়ংগুক-কে মাস্টার পেইন্টার হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান। দেশ দুটি ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। ফলে নেপাল ও ভুটানের শিল্পীরাও ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে। নেপালে একজন শিল্পীকে ধার্মিক লোক হিসেবে গণ্য করা হয়। কেমন হবেন শিল্পী তার প্রচলিত আদর্শিক ব্যাখ্যা রয়েছে নেপালে। নেপালের জনগণ বিশ্বাস করে যে, ‘শিল্পী অবশ্যই সৎ হবে, কর্মঠ এবং নিষ্ঠাবান হবে, শিল্পী রাগ অনুরাগের দ্বারা চালিত হবে না, শিল্পী হবে পবিত্র এবং নির্মল মনের অধিকারী, হবে ধার্মিক ও পরোপকারী, শিল্পী হবে ধনলিপ্সাহীন এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। শিল্পী সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা শিল্পীকে মহামানবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ব্যাখ্যানুযায়ী শিল্পীকে সব মানুষের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। যে শিল্পীকেই এমন মর্যাদা দেয়া হয়েছে সেই শিল্পীর কর্মকাণ্ড যে, জনকল্যাণমূলক হবে, জনগণের ধর্ম বিশ্বাসকে শক্তিশালী করবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। কারণ শিল্পীকে দেয়া সম্মান অক্ষুণœ রাখতে শিল্পী সব সময় তৎপর এবং সতর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক কারণেই নেপালের শিল্পকর্মে নেপালের জনগণের ধর্ম বিশ্বাস এবং নেপালের নিজস্ব সংস্কৃতি মূর্ত হয়ে ওঠে। একইভাবে ভুটানের শিল্পীরাও তাদের ধর্ম এবং নিজ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পকর্ম করে। যারা পশ্চিমা ধারায় কাজ করে তারাও নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসে অবিচল থাকে। পশ্চিমা ধারায় শিল্প শিক্ষা দোষণীয় নয় বরং এশীয় শিল্প শিক্ষার পাশাপাশি এ শিক্ষা জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটায়, যা শিল্পাঞ্চল পদ্ধতিকে সমৃদ্ধ করে। কারণ এটা এক ধরনের পদ্ধতি। পশ্চিমা কিংবা এশীয় যে কোনো পদ্ধতিতেই জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিল্প চর্চা করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছার। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাচ্য ধারার বিস্তার ঘটছে। এ ধারা এশিয়ার নিজস্ব ধারা বা পদ্ধতি। তবে শিল্পীরা এশীয় এবং পশ্চিমা উভয় ধারার সংমিশ্রণে জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিল্প চর্চা করছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জাতীয়তাবাদী ধারা বিস্তার লাভ করবে এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। এ প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে নববর্ষ ২০১৮ সালে শিল্পীরা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এই কামনা করি।ড. আব্দুস সাত্তার