মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দলের চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা মোকাবেলায় আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক তথা আন্দোলনেরও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আদালতকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি রায় দিতে চায়। এর মাধ্যমে তারা সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার পাশাপাশি নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। বিএনপি বলছে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা মিথ্যা, বানোয়াট। তারপরও সরকার একটি রায় পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দলটি বলছে, তারই অংশ হিসেবে বেগম জিয়ার ১৪টি মামলা আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। জানা গেছে, বিএনপি সরকারের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে। বেগম জিয়ার মামলার বিষয়ে তারা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। এরই মধ্যে তারা বলেছে, দলের চেয়ারপার্সনকে ছাড়া বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। একইসাথে মামলাগুলো আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও মোকাবেলা করতে বিএনপি প্রস্তুত আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অনির্বাচিত এই সরকার বেগম খালেদা জিযার বিরুদ্ধে মামলাগুলো ব্যবহার করছে। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব মামলা অব্যাহত আছে, এ মামলাগুলো বিচারের সাথে সম্পর্কিত কোনো মামলা নয়। পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এ মামলাগুলো করা হয়। আজকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অনির্বাচিত এই সরকার মামলাগুলো ব্যবহার করছে। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ১/১১-এর সময় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ মামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হয়েছিল। কিন্তু তার সে মামলাগুলো উধাও হয়ে গেছে। আর বেগম খালেদা জিয়ার মামলাগুলো অব্যাহতভাবে চলছে। তিনি আরো বলেন, আজকে তারা রাষ্ট্রীয় অন্য সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এর সাথে সাথে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারলে তাদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করে যে, বিচার বিভাগ থেকে হয়তো কোনো ধরনের বাধা আসতে পারে। যেখানে জনগণের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে অবস্থায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ যাতে তাদের ভূমিকা স্বাধীনভাবে পালন করতে না পারে, সেই ব্লু প্রিন্টের অংশ হিসেবে তারা (সরকার) বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। একদিকে তাদের নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে হয়রানি করা হচ্ছে, তাকে দেশের মানুষের সামনে খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে তাকে এবং তার পরিবারকে খাটো করার জন্য সৌদি আরবের দুর্নীতির কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। এটা তাদের টেকনিক। তিনি আরও বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে যেন অংশগ্রহণ করতে না পারেন, সেজন্য বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে সরকার। রাজপথে কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, কর্মসূচি আসবে। কিন্তু সময় করে, আরও পর্যবেক্ষণ করে যা করণীয়, তাই করবো আমরা।
সূত্র মতে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দুটো শেষ না হতেই আরও ১৪টি মামলা বকশীবাজারে সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে নেওয়া হয়েছে। বিএনপি এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও এর পেছনে সরকারের কী উদ্দেশ্য তা বুঝতে সময় নিচ্ছে। এরই মধ্যে গত সোমবার রাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোনও অবস্থাতেই খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামীতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে না। দলটির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার মামলা বিশেষ আদালতে নেওয়ার মানেই হচ্ছে, তাকে হয়রানি করা। এ কারণে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির প্রচারণা স্তিমিত করতেই চেয়ারপার্সনের মামলাগুলো সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিএনপি নেতারা এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছেন। তারা আত্মবিশ্বাসী যে, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলা থেকে খালেদা জিয়া খালাস পাবেন। তবে এক্ষেত্রেও তাদের কিন্তু আছে। তাদের মতে, আদালত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত না হয়ে রায় দিলেই খালেদা জিয়া খালাস পেতে পারেন। বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার নতুন মামলাগুলো নিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। সরকার চাইছে, আগামী নির্বাচন থেকে তাকে দূরে রাখতে। এক্ষেত্রে আইনি পথেই উদ্দেশ্য হাসিল করা হবে। তবে বিএনপি আদালতে লড়াই অব্যাহত রাখলেও ভেতরে-ভেতরে রাজপথে কর্মসূচি ও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে দলটির হাইকমান্ড। খালেদা জিয়ার মামলার দিকে নজর রয়েছে ২০ দলীয় জোট নেতাদেরও। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, আগে সরকারের অবস্থান বোঝা দরকার। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, করণীয় কী হবে। আবার কোনও কোনও নেতার ভাষ্য, খালেদা জিয়ার বিষয়ে বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
খেলাফত মজলিসে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, আইনি লড়াই করতে হবে আগে। এরপর পরিস্থিতি, পরিবেশই বলে দেবে কী করতে হবে। আগে আইনের প্রতি কোনও অবহেলা করতে চাই না। যেভাবে যুক্তিতর্ক চলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে খালেদা জিয়া ন্যায়বিচার পাবেন। তারপরও খালাস না পেলে অবস্থাই বলে দেবে করণীয় কী।
চলমান মামলা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে হেয় এবং দলকে বিকল করার জন্য মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বলেন, আমি প্রতিটি সাক্ষীর যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছি, খালেদা জিয়া নির্দোষ। আমি আশা করছি খালেদা জিয়া মামলা থেকে খালাস পাবেন। এই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোনও ভিত্তি নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কাগজপত্রে খালেদা জিয়ার কোনও স্বাক্ষর নেই, সিল নেই। ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে খালেদা জিয়া কিছ্ইু জানেন না। এই মামলাটি করা হয়েছে জরুরি অবস্থায়। ২০০৬ সালে যখন জরুরি অবস্থা হলো, তখন মইনুল ও ফখরুল আহমেদ ম্যাডাম জিয়াকে মাইনাস টু ফর্মুলা করে এই মামলাটি সৃজন করেছেন।
খালেদা জিয়ার মামলা: বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা ১৪টি মামলার বিচার চলবে বকশীবাজার সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষ্য, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নয়। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বকশীবাজারের অস্থায়ী আদালতে এই মামলাগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে। সোমবার (০৮ জানুয়ারি) আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে যে ১৪টি মামলা স্থানান্তরের কথা জানানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে ৯টি, বিশেষ জজ আদালতে ৩টি ও ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ২টি মামলা বিচারাধীন আছে। এসব মামলার মধ্যে ১১টিই বর্তমান সরকারের আমলেই দায়ের করা। মামলাগুলো হলো দারুস সালাম থানায় করা নাশকতার আট মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা, যাত্রাবাড়ী থানায় করা বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা ও মানহানির অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলা।
নাশকতার আট মামলা: ২০১৫ সালের প্রথম দিকে বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর দারুস সালাম থানায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লার আদালতে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি মামলাগুলোর অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা: ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি রাতে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোলবোমা ছোড়ার ঘটনায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করে পুলিশ। এরপর খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২৫ জানুয়ারি এ মামলায় অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে।
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায়: গ্যাটকো দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটির অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ২১ জানুয়ারি তারিখ ধার্য রয়েছে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক আবু সৈয়দ দিলদারের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন।
নাইকো দুর্নীতি মামলা: নাইকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ১৫ জানুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯-এর বিচারক মাহমুদুল হাসানের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন।
কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা: বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১১ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হোসনে আরা বেগমের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন।
মানহানির দুই মামলা: বাংলাদেশের মানচিত্র ও মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্বকে কলঙ্কিত এবং জাতীয় পতাকাকে অপমানিত করার অভিযোগে জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী ২০১৬ সালের ৩ নবেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করেন। ওই দু’টি মানহানির মামলা ঢাকা মহানগর হাকিম খুরশীদ আলমের আদালতে আগামী ২১ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
১১জানুয়ারী,২০১৮বৃহস্পতিবার::ক্রাইমর্বাতা.কম/সংগ্রাম/আসাবি