সিনহার পদত্যাগ আগামী জাতীয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে?

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:ঢাকা: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকার ও বিচার বিভাগের মুখোমুখি অবস্থান আগামী জাতীয় নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশে নির্বাচনের বছরে সাধারণ মানুষের আলোচনাতেও ঘুরে ফিরেই উঠে আসে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগের বিষয়টি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের বাইরেই অনেক কিছুর স্বাক্ষী প্রাচীন বটগাছের নিচেও মানুষের জটলায় চলছিল এ নিয়ে আলোচনা। নানা বয়সের ও নানা শ্রেণি পেশার এই মানুষেরা স্বাভাবিকভাবেই ইস্যুটি ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত। তবে সবাই একমত আসন্ন নির্বাচনেও ঘুরে ফিরে আসবে সিনহার পদত্যাগের বিষয়টি।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক কলেজ শিক্ষক আবদুল আলিম মনে করেন, সরকার স্পষ্টতই বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তবে ব্যাংকার তরিকুল ইসলাম অবশ্য বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই নিজে থেকে পদত্যাগ করেছেন সিনহা। দু’জন আইনজীবীও যোগ দেন এ আলোচনায়। তাদের একজন শুভংকর শঙ্কিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে। তবে অন্যজন মনে করেন যা হয়েছে নিয়ম মেনেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরির মতে, এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

তিনি বলেন, “আমরা এখন এমন একটা বিচার বিভাগ নিয়ে ইলেকশন করতে যাচ্ছি, যে বিচার বিভাগটা ভীষণভাবে বিতর্কিত। যে বিচার বিভাগ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে যে, সরকার এটাকে হাতের মুঠোয় নেয়ার চেষ্টা করছে। এখন যদি বিচার বিভাগ নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠে, যদি তারা মনে করে যে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের কথা শুনে চলে, তাহলে কিন্তু এই বিচার নির্বাচন পরিবর্তী কোনও কিছুতে ভূমিকা রাখতে গেলে জনগণ তা মেনে নেবে না”।

এই বিতর্কে বাংলাদেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপির বরাবরই ছিল সুস্পষ্ট সরকার বিরোধী অবস্থান। এই দলটি বিগত নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থেকেছিল। যদিও পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে তারা অংশ নেয় এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নেবে বলে একটি জোর ধারণা আছে। তবে এখন পর্যন্ত দলটি তাদের নির্বাচন সংক্রান্ত দাবি দাওয়া সম্পর্কে অনড় অবস্থানই ধরে রেখেছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলছিলেন, তারা নির্বাচনে গেলে এই ইস্যুটিকে অবশ্যই বড় করে সামনে আনবেন।

“এটা এখন আরো বেশি অগ্রাধিকার পাবে বর্তমান সরকারের আচরণের কারণে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অবশ্যই বিচার বিভাগের ওপর আওয়ামী লীগের এই সরাসরি হস্তক্ষেপের বিষয়টি সামনে আনবে”।

প্রধান বিচারপতির সাথে সরকারের টানাপোড়েন চলাকালে বিএনপি যেসব প্রশ্ন তুলেছে, সেসবের জবাবও সরকারি দল আওয়ামী লীগ দিয়ে গেছে অব্যাহতভাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলছিলেন, এই ইস্যুটি এখন মৃত। এখান থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার আর কোনও সুযোগ নেই।

তারপরও যদি ভোটের রাজনীতিতে বিরোধীরা ইস্যুটিকে সামনে আনার চেষ্টা করে, তবে তারাও তৈরি বলে জানান এ উপদেষ্টা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, “দেখুন ভোট দেয়ার সময় সাধারণ মানুষ এত হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের মত বিষয় বিচার করে না। তারপরও যদি নির্বাচনে এ ইস্যুটি আসেও, তাহলে আমাদের কাছে যথেষ্ট দালিলিক তথ্য প্রমাণ আছে যে, এখানে বিচার বিভাগের ওপর কোনও হস্তক্ষেপ হয়নি”।

তার দাবি, বিচারপতিদের সরিয়ে দেয়ার জন্য বয়স কমানো বা বাড়ানোর ঘটনা ঘটেছে বিএনপির আমলেই। ইতিহাস বলছে- বাংলাদেশে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতার বদল ঘটেছে প্রায়ই। ১৯৭২ সালের সংবিধানে এটা ছিল সংসদের হাতে। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়।

১৯৭৮ সালে আবার বিচারপতিদের অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিল করে গঠিত হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল৷ যেটা বাতিল হবার মাধ্যমে পরিষ্কার হয় সরকার ও বিচারবিভাগের মুখোমুখি অবস্থান।

তাইতো অনেকে মনে করেন, আওয়ামী সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ হয়ে উঠতে পারে আগামী নির্বাচনে বড় নিয়ামক।

এদিকে অচিরেই বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টে একজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

গত বছরের ১০ নভেম্বর বিদেশে বসে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেই থেকে দু’মাসের বেশি সময় ধরে নতুন কোন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেননি রাষ্ট্রপতি।

এর আগে বাংলাদেশে কখনোই এত দীর্ঘ সময় ধরে প্রধান বিচারপতির পদটি ফাঁকা থাকেনি। এমনকি প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য ঘোষণা করে কোনও গেজেট নোটিফিকেশনও জারি করেনি সরকার।

অবশ্য পদত্যাগের আগে যখন ছুটিতে ছিলেন সিনহা তখন যে জেষ্ঠ্য বিচারপতি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন, সেই আবদুল ওয়াহহাব মিয়াই এখনও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

কিন্তু আবদুল ওয়াহহাব মিয়ার প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেয়া না থাকবার কারণে নতুন বিচারপতিদের তিনি শপথ পড়াতে পারেন না। যেটাকে একটি শূণ্যতা হিসেবে দেখেন কোনও কোনও বিশ্লেষক। পুরো পরিস্থিতিকে নজিরবিহীন বলেও বর্ণনা করেন কেউ কেউ।

কিন্তু এতে কোনও সমস্যা দেখছেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বলেন, “এটা তড়িৎ নিয়োগ হতে হবে, সেরকম কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কিন্তু নেই”।

তিনি আরো বলেন, “সংবিধানের পঁচানব্বই অনুচ্ছেদে বলা আছে, এটা সম্পূর্ণ মহামাণ্য রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। সেই মতে উনি কখন নিয়োগ দেবেন, আমিতো এটা বলতে পারব না। কিন্তু আমি আশা করি খুব শিগগিরই এটা হবে”।

সরকার বিচার বিভাগকে করায়ত্ব করার চেষ্টা করছে, বিরোধী দলগুলোর এমন অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে আইনমন্ত্রী বিচারবিভাগকে স্বাধীন বলেও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “আমরাতো দেখিয়ে দিচ্ছি স্বাধীনভাবে বিচার হচ্ছে। মানুষ স্বাধীনভাবে বিচার পাচ্ছে। জনগণ আদালতে যেতে পারছে”।

১২জানুয়ারী,২০১৮শৃক্রবার::ক্রাইমর্বাতা.কম/-বিবিসি/আসাবি

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।