বিশ্ব ইজতেমা শুরু ….দিল্লিতে ফিরে যাচ্ছেন মাওলানা সাদ

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:তুরাগ তীরে আজ বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। তবে এতে যোগ দিচ্ছেন না মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভী। কওমিপন্থী আলেম, হেফাজতে ইসলাম ও তাবলিগ কর্মীদের একাংশের বিরোধিতার মুখে তিনি ফিরে যাচ্ছেন দিল্লিতে। তাকে নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত দু’পক্ষকে নিয়ে ২ ঘণ্টা বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘উনি ইজতেমায় যাবেন না। সুবিধাজনক সময়ে তিনি বাংলাদেশ থেকে চলে যাবেন। দু’পক্ষই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে।’

বুধবার দুপুরে ঢাকায় আলেম-ওলামা ও তাবলিগের একাংশের বিক্ষোভের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান মাওলানা সাদ। সেখান থেকে বিকালে কঠোর নিরাপত্তায় তাকে নেয়া হয় বাংলাদেশে তাবলিগের কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সুবিধাজনক সময়ে মাওলানা সাদ বাংলাদেশ ছাড়বেন। তবে যতদিন বাংলাদেশে থাকবেন ততদিন কাকরাইল মসজিদেই থাকবেন।’ মন্ত্রী বলেন, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা যথাসময়ে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে হবে। যাদের নিয়ে বিতর্ক ছিল তাদের নিয়ে একটা সমঝোতায় তারা এসেছেন। আশা করি এ সিদ্ধান্তের পর কাল থেকে আর কেউ সড়কে নামবেন না। সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে হবে। তিনি আরও বলেন, ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত কে পরিচালনা করবেন তা ঠিক করবেন তাবলিগ জামাতের মুরব্বিরা।

আসাদুজ্জামান খান বলেন, বাংলাদেশ তাবলিগের ১১ সদস্যের শূরা কমিটির দু’জন বাদে সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ওই বৈঠকে ছিলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর মাওলানা সাদের বিষয়ে ‘সর্বসম্মতভাবে’ এসব সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রী বলেন, ‘যাদের নিয়ে বিতর্ক তারা সবাই সমঝোতায় এসেছেন। বর্তমানে যে বিরোধ চলছে আগামীতে তা আরও ভালোভাবে মিটে যাবে।’

বৈঠকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, আজ বাদ জুমা মাওলানা সাদ হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি ফিরে যাবেন।

ইজতেমার বাইরে মাওলানা সাদকে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ময়দানে এর প্রভাব বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেখা যায়নি। মুসল্লিরা নিয়মিত কাজ ও ইবাদতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। ভোলা থেকে আসা নজির উদ্দিন বলেন, মাঠে আমরা ধর্মের কাজে এসেছি। মুরব্বিদের বয়ান শুনছি। আল্লাহকে রাজি-খুশি করে চলব। অন্যকিছুতে মনোযোগ দেয়া বা কারও উদ্দেশ্যপূরণ নিয়ে ভাবছি না।

কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে মুসল্লিরা ময়দানে সমবেত হয়েছেন। তাদের ইবাদত-বন্দেগি জিকির-আসগারে বৃহস্পতিবারই ময়দান পেয়েছে চেনারূপ। আজ এখানে জুমায় শরিক হবেন কয়েক লাখ মুসল্লি। বিদেশি মুসল্লিদের অনেকে এরই মধ্যে ময়দানে এসেছেন। অনেকেই পৌঁছাবেন আজ। আয়োজকরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি বিদেশি মেহমান ময়দানে এসেছেন। বিদেশি যারা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে চিল্লায় ছিলেন তাদের বেশিরভাগই ময়দানের পথে রয়েছেন।

বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসী ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ এবং দেশের সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। বৃহস্পতিবার এক বাণীতে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, এ মহান ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখবে। দেশ ও বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করবে।’

বৃহস্পতিবার মুসল্লিদের উদ্দেশে প্রস্তুতিমূলক বয়ান করা হয়। মুসল্লিরা তিন দিন কীভাবে অবস্থান করবেন সে বিষয়ে দেয়া হয় নির্দেশনা। রোববার দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ইজতেমার প্রথম পর্ব।

তাবলিগ জামাতের মূল কেন্দ্র দিল্লিতে। নিজামউদ্দিনের কেন্দ্রীয় ওই পর্ষদ (শূরা) ১৩ সদস্যের। এ পর্ষদের সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভি সম্প্রতি নিজেকে আমীরে ফয়সাল (প্রধান) দাবি করে বসেন। পাশাপাশি কয়েকটি ‘বিতর্কিত’ মন্তব্যের জের ধরে মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন ভারতের দেওবন্দের আলেমরা। ফলে তার বাংলাদেশে আসা নিয়ে বাংলাদেশে তাবলিগের মূল দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এরই জের ধরে বাংলাদেশেও কওমি আলেমরা তাকে প্রতিহতের ঘোষণা দেন। বুধবার দিনভর বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় তারা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাবলিগের একাংশও এতে যোগ দেয়।

এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন মাওলানা সাদ কান্ধলভী। বিক্ষোভের মধ্যে বিকালে তাকে কাকরাইল মসজিদে নেয়া হলে সন্ধ্যায় সাদবিরোধীরা কাকরাইল মসজিদের সামনে জড়ো হন। সেখান থেকে তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। ওই মসজিদ ঘিরে অবস্থান নেয় পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকালে নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়।

দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে সমাবেশ করে কওমিপন্থী আলেম ও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। তারা সন্ধ্যার মধ্যে মাওলানা সাদকে বাংলাদেশ থেকে ভারতের দিল্লিতে ফেরত পাঠানোর দাবি তোলেন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক ফজলুল হক কাশেমী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে বলেন, ‘তাকে (মাওলানা সাদ) সরালে দেশ শান্ত হবে। গাড়ি-ঘোড়া চলবে। নইলে সব বন্ধ হবে।’ ফজলুল হক কাশেমীর বক্তব্য, দেশকে অশান্ত করার চেষ্টা চলছে। তাকে (মাওলানা সাদ) না আনতে বলা হয়েছিল।

পরে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিভক্ত দুই গ্রুপের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

ইজতেমা : প্রথম পর্বে ১৪ জেলার মুসল্লিরা ২৮ খিত্তায় ময়দানে অবস্থান করছেন। এগুলো হল- ঢাকা (খিত্তা ১-৮, ১৬, ১৮, ২০ ও ২১), পঞ্চগড় (৯), নীলফামারী (১০), শেরপুর (১১), নারায়ণগঞ্জ (১২ ও ১৯), গাইবান্ধা (১৩), নাটোর (১৪), মাদারীপুর (১৫), নড়াইল (১৭), লক্ষ্মীপুর (২২ ও ২৩), ঝালকাঠি (২৪), ভোলা (২৫ ও ২৬), মাগুরা (২৭) ও পটুয়াখালী (২৮)।

চিকিৎসাসেবা : গাজীপুর সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মঞ্জুরুল হক জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিকেল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানে ৫টি বিশেষজ্ঞ টিম মুসল্লিদের চিকিৎসা দেবে। মুসল্লিদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা গেট, বিদেশি মেহমান খানা ও তুরাগের পশ্চিম তীরে আরও ২টি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন স্থানে বিনা মূল্যে সেবা দিচ্ছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. জাহিদ আহসান রাসেল ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখেন। এ সময় তিনি মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ, টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি ও ইবনে সিনার ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। এ সময় আরও ছিলেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নূরুল ইসলাম নূরু, মো. গিয়াস উদ্দিন, এমএ লতিফ, রুহুল আমিন মনির সরকার প্রমুখ। রাসেল বলেন, বিদেশি মেহমানখানার পাশে একটি বিশেষ কামরায় আমি ইজতেমার দুই পর্বেই অবস্থান করে আগত মুসল্লিদের খেদমতে থাকব।

লঞ্চ থেকে পড়ে নিখোঁজ : লালমোহন (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, ইজতেমার উদ্দেশে রওনা হয়ে লঞ্চ থেকে তেঁতুলিয়া নদীতে পড়ে রাসেল (৩৫) নামে এক যুবক নিখোঁজ রয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় এমভি গ্লোরি অব শ্রীনগর-৩ লঞ্চ থেকে পড়ে যায় ওই যুবক। রাসেল লালমোহন নয়ানীগ্রামের আবদুল হাই হাওলাদারের ছেলে। লালমোহন মসজিদ রোডে বিসমিল্লাহ ইলেকট্রুনিক্সের মালিক সে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে জানান কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান খোকন।

বেনাপোল হয়ে আসছেন বিদেশি মুসল্লিরা : বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, ইজতেমায় যোগ দিতে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ’ বিদেশি মুসল্লি বাংলাদেশে আসছেন। এক সপ্তাহে এ সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি বলে জানিয়েছেন তাবলিগের সদস্য কামাল হোসেন। বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আখেরি মোনাজাতের আগের দিন পর্যন্ত মেহমানরা আসবেন।

পরিবহন স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে আসা মুসল্লিরা দুর্ভোগে পড়ছেন। কুয়াশার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিবহন না আসায় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ইজতেমায় যোগ দিতে আসা বিদেশি মেহমানরা ৫০০ টাকার ভ্রমণকর নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

১২জানুয়ারী,২০১৮শৃক্রবার::ক্রাইমর্বাতা.কম/প্রতিনিধি/আসাবি

Check Also

৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।