ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:যশোর রোডের ঐতিহাসিক গাছগুলো যাতে না কাটা হয়, তা নিয়ে কয়েকদিন ধরেই সোচ্চার পরিবেশবাদীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও সমালোচনা-প্রতিবাদের ঝড় চলছে। আসছে আন্দোলনের হুমকিও। এত কিছুর মধ্যেও সবাই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন- মুক্তিযুদ্ধ ও স্থানীয় মানুষের আবেগের স্মৃতিবিজড়িত গাছগুলো রক্ষা পাবে তো? তারা গাছগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় ‘যশোর রোড’ হিসেবে পরিচিত যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দু’পাশের গাছ কেটে রাস্তা প্রশস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরই শুরু হয় সমালোচনা। ভাইরাল হয়েছে এ সড়কের দু’পাশের গাছের ছবিও। ঢাকার গণমাধ্যমকর্মী আশিকুর রহমান জ্যাকি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন এই বৃক্ষরাজি। তারা দেখেছে জমিদার কালী পোদ্দার, রাজমাতা যশোদা দেবী, রাজা প্রতাপাদিত্য, শেরশাহ সুরীকে- যাদের আমরা কেউ দেখিনি।
এই সড়ক ও বৃক্ষগুলো দেখেছে মুঘল আমল, বারো ভূঁইয়াদের আমল, ব্রিটিশ শাসন ও তাদের প্রস্থান। দেখেছে দাঙ্গা ও ভারত-বিভক্তির ফলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম। প্রত্যক্ষ করেছে, দাঙ্গার ফলে কোটি মানুষের মানচিত্র পরিবর্তন ও রক্তপাত। যশোর রোড বিশ্ব-ইতিহাসের আরেকটি বিশেষ ঘটনারও সাক্ষী। একটি জাতির জন্মযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এই সড়ক ও প্রাচীন গাছগুলো। একাত্তরের পাক-হানাদারদের আক্রমণের ফলে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারত আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদের বেশিরভাগই যশোর রোড ধরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন এ পথ ধরেই হেঁটে গিয়েছিল লাখো-কোটি বাংলাদেশি শরণার্থী এবং তাদের এই গাছগুলিই ছায়া দিয়ে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল।’
গাছ রেখে রাস্তা প্রশস্তকরণের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণাকারী যশোরের বামপন্থি নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, এ সড়কের দু’পাশে ৫০ ফুটের মতো খালি জায়গা রয়েছে। ফলে তা ব্যবহার করলে গাছ রেখেই রাস্তা চার লেনে উন্নীত করা সম্ভব। তার অভিযোগ, রাস্তা সম্প্রসারণের চেয়ে গাছ কেটে লুটপাট করায় বিশেষ একটি মহলের বেশি আগ্রহ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, যশোরের জমিদার কালী পোদ্দার তার মাকে সোজা পথ দিয়ে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয়ে ১৮৪২ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদিয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। আর ৮০ কিলোমিটারের ওই রাস্তার ছায়ার জন্য দু’ধারে কালীবাবু বিদেশ থেকে এনে অতিবর্ধনশীল রেইনট্রির চারা রোপণ করেছিলেন। সেই বৃক্ষগুলো যশোর-বেনাপোল সড়ককে এখনও ছায়া দেওয়ার পাশাপাশি অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর যশোর থেকে কলকাতার মানিকতলা পর্যন্ত এই সড়কটির নামকরণ হয় যশোর রোড নামে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড দিয়ে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। শরণার্থীদের সেই ঢল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতা লেখেন। যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক বব ডিলান সেই কবিতাকে গানে রূপ দিয়ে তা গেয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিল সংগ্রহের জন্য।
ইতিহাসের সাক্ষী এই সড়কটি এশিয়ান হাইওয়েতে অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। সে লক্ষ্যে সড়কের যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। গত মার্চ মাসে সড়কটি পুনর্নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন হলে সড়কের দু’পাশের গাছ কেটে ফেলে রাস্তা প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু গাছগুলোকে কেটে রাস্তা সম্প্রসারণের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বেশিরভাগ মানুষ। এ নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার হলে সড়ক বিভাগ তাদের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। গত জুলাইয়ে তারা ঘোষণা দেয়- আপাতত এ গাছগুলো রেখেই দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলকে সংযুক্তকারী যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়কের সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন তারা। কিন্তু ৬ জানুয়ারি সভায় বিশেষজ্ঞ মতামতের উদ্ৃব্দতি দিয়ে জানানো হয়, গাছগুলোকে রেখে রাস্তা প্রশস্ত করা সম্ভব নয়। ওই সভায় সড়ক বিভাগের দুজন অতিরিক্ত সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত সবাই গাছ কাটার পক্ষে মত দেন। এর পর পরই এ মহাসড়কটি পুনর্নির্মাণের জন্য প্রাচীন ওই তিন শতাধিক রেইনট্রিসহ কাটার তোড়জোড় চলছে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য খুব শিগগির দরপত্র আহ্বান করা হবে। আগামী মাসে কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যশোরের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রকল্পটি যেভাবে হয়েছে, তা বাস্তবাযন করতে গেলে গাছ কাটার কোনো বিকল্প নেই।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, সড়কটির দু’পাশে ঘনবসতি এবং বড় বড় স্থাপনা রয়েছে। বেনাপোল দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর হওয়ায় এখানে এমনিতেই ভারী যানবাহনের চাপ থাকে। এরপর এ মহাসড়কের পাশে নতুন করে গড়ে উঠছে বৃহৎ অর্থনৈতিক জোন। ফলে সংকীর্ণ এ রাস্তাটি প্রশস্ত করা জরুরি। এ ছাড়া প্রাচীন গাছগুলো এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে গাছগুলো কেটে ফেলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
যশোরের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলও একই কথা বলেন। তিনি জানান, সর্বসম্মতিক্রমে গাছ কাটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। গাছগুলো অনেক পুরনো এবং গাছের ডালপালা ভেঙে সম্প্রতি অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তবে সরকারি সিদ্ধান্ত যাই হোক, মহাসড়কটির দু’পাশে বসবাসকারীদের দাবি, পুরনো গাছগুলো টিকিয়ে রেখে রাস্তা প্রশস্ত করা হোক। আর তা করা হলে একদিকে যেমন ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো টিকিয়ে রাখা যাবে, তেমনি মহাসড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। রক্ষা করা যাবে পরিবেশের ভারসাম্যও। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, উন্নয়নের স্বার্থে গাছ কাটতেই যদি হয়, তাহলে নতুন সড়কের পাশেও যেন নতুন করে গড়ে তোলা হয় সবুজ বেষ্টনী। গ্রিন ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শেখ আশিক মাহমুদ সবুজ বলেন, এ মহাসড়কের ভারত অংশে পুরনো গাছগুলো বিশেষ উপায়ে রেখে রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে। একই উপায়ে এপাড়ে করা হলে একদিকে যেমন ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো টিকিয়ে রাখা যাবে, তেমনি মহাসড়কের সৌন্দর্য বাড়বে।
১৫জানুয়ারী,২০১৮সোমবার::ক্রাইমর্বাতা.কম/সমকাল/আসাবি