আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন নিবন্ধন পরিদফতরে নজিরবিহীন বেআইনী নিয়োগ

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: নিবন্ধন পরিদফতর আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। যেটি সারা দেশের ভূমি রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন এই ভূমি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম অর্থাৎ দেশের রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর কর্মকান্ড নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশের রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে এমন কিছু দুর্নীতি-অনিয়ম শুরু হয়েছে, যার নজির অতীতে নেই। এতে সরকারের আইন-কানুন এবং বিধি-বিধানকেও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংক্রান্ত আইন-কানুন, বিধি-বিধানের মূল ভিত্তি হলো এস্টাব্লিসমেন্ট ম্যানুয়াল। সেই এস্টাব্লিসমেন্ট ম্যানুয়ালেরই কোটা সংক্রান্ত বিধি-বিধানে জেলা পযায়ে কর্মচারী নিয়োগের বিষয়ে এই মর্মে বাধ্যবাধকতা দেওয়া আছে যে, প্রত্যেক সরকারি দফতর, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার জেলা পর্যায়ের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর নিয়োগগুলো হবে ওই জেলার নাগরিকদের মধ্য থেকে। বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে জেলা পর্যায়ের নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে। সাধারণত, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নিয়োগ কমিটি গঠিত হয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট দফতরের জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে। প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা বিভাগ থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি দফতরে এই প্রক্রিয়ায়ই জেলা পর্যায়ের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ হয়ে আসছে। নিবন্ধন পরিদফতরেও এই নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলে আসছিল ইতিপূর্বে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে জেলা পর্যায়ে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দেদারছে। ইতিমধ্যে অন্তত ৬০ জন কর্মচারী এভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরও নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
নিবন্ধন পরিদফতরের আইজিআর (মহাপরিদর্শক নিবন্ধন) খান মো. আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে এই নিয়োগগুলো চলছে। তিনিই এসব নিয়োগ কমিটির প্রধান। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের জন্য নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে তার নামেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হচ্ছে। তিনিই পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জেলা পর্যায়ে পদায়ন করছেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
শুধু এস্টাব্লিসমেন্ট ম্যানুয়ালই নয়, নিবন্ধন পরিদফতরের কর্মকা- পরিচালনার জন্য নিবন্ধন ম্যানুয়াল, ২০১৪ নামে যে বিধান কার্যকর আছে সেটিও চরমভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বর্তমানে। নিবন্ধন পরিদফতরে দীর্ঘকাল থেকেই প্রচলিত আছে এবং আইন দ্বারাও বাধ্য করা হয়েছে যে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অফিস সহকারী ও সমমানের পদগুলো পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে এক্সট্রা মোহরার নামে পরিচিত এক ধরনের কর্মচারী রয়েছেন, যাদের পদ স্থায়ী নয়। এরা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। এদের মধ্য থেকেই মোহারার’র শূন্য পদে নিয়োগ করার বিধান রয়েছে। অফিস সহকারীর শূন্য পদগুলো পূরণ হবে মোহরার থেকে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে। অফিস সহকারীদের মধ্য থেকে প্রধান সহকারীর শূন্য পদগুলো পূরণ করা হয়। এক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতা অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের এ পদগুলোতে বাইরে থেকে কাউকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে সরাসরি নিয়োগের কোনও সুযোগই আদৌ নেই। নিয়ম অনুযায়ী, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের এ পদগুলো পূরণের দায়িত্ব অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে সংশ্লিষ্ট জেলা নিবন্ধকের নেতৃত্বাধীন নিয়োগ কমিটি।
কিন্তু, বর্তমানে এই বিধি-বিধানও লঙ্ঘন করা হচ্ছে। পদোন্নতির মাধ্যমে মোহরার ও অফিস সহকারী পদে এক্সট্রা মোহরারদের মধ্য থেকে নিয়োগ না করে বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাও সরাসরি নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এমন গুরুতর অনিয়ম চলছে। জানা গেছে, এই অনিয়ম-অপকর্ম শুরু হয়েছে ২০১৬ সালে অর্থাৎ বর্তমান আইন মন্ত্রীর আমলে। বর্তমানে এসব অনিয়ম চূড়ান্ত রূপলাভ করেছে। এ নিয়ে নিবন্ধন পরিদফতরের মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের নিবন্ধন কার্যালয়গুলোতে ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা মিছিল-সমাবেশ ও ধর্মঘটও করেছে বিভিন্ন স্থানে। তারপরও এসব অপকর্ম বন্ধ হয়নি।
জানা গেছে, প্রথমে ২০১৬ সালে নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়ে এদেরকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বদলি করা হয়, নিবন্ধন ম্যানুয়েল, ২০১৪ অনুযায়ী যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। মিছিল-সমাবেশ ও ধর্মঘট হয়। কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের এই বৈধ আন্দোলন দমাতে গিয়ে হয়রানি-নির্যাতনের নীতি অনুসরণ করে। কয়েকজন কর্মচারী নেতাকে ঢাকার বাইরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। অন্যদেরও হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। অবশেষে আন্দোলন দমাতে সফলও হয় কর্তৃপক্ষ। আর এর পর শুরু হয় কর্তৃপক্ষের লাগামহীন অবৈধ কর্মকা-। নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে আইন বহির্ভুতভাবে একের পর সার্কুলার দিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বাইরে থেকে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। এতে এক জেলার লোক আরেক জেলায় নিয়োগের সুযোগ পেয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
জানা গেছে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ১৩ জন কর্মচারী নিয়োগের জন্য নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে গত ২২ জুলাই, ২০১৭ একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ১৩ জনের মধ্যে ১২ জন অফিস সহকারী এবং ১ জন নৈশ প্রহরী। খান মো. আবদুল মান্নান, মহাপরিদর্শক, নিবন্ধন- এর নামে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এর আগে ৫ মার্চ, ২০১৭ একইভাবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ১০টি অফিস সহকারী এবং ৫টি নৈশ প্রহরী পদ পূরণের জন্য নিবন্ধন পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে খান মো. আবদুল মান্নানের নামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “নিবন্ধন পরিদপ্তরাধীন জেলা পর্যায়ের জেলা রেজিস্ট্রার/ সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়সমুহে নি¤œবর্ণিত শূন্য পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশী নাগরিকদের নিকট থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা যাচ্ছে। ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রি অফিসে ৩ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগের জন্য ২০১৬ সালের ২ আগস্ট খান মো. আবদুল মান্নান, মহাপরিদর্শক, নিবন্ধন এর নামে তার কার্যালয় থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নিবন্ধন কার্যালয়গুলোতে এভাবে অন্তত ৬০ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সরকারের আইন-কানুন সরাসরি লঙ্ঘন করে।
জানা গেছে, এসব প্রতিটি নিয়োগে বড় অংকের ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। অফিস সহকারী পদে নিলামে ডাক উঠার মতো ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষের রেট উঠেছে। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়েরও একটি চক্র জড়িত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে দাবি করেছে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৮ জানুয়ারি, ২০১৮ প্রকাশিত)

 

Check Also

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কম্বল বিতরণ

গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের উদ্যোগে অসহায় ও দুস্থ শীতার্ত মানুষের মধ্যে কর্কশিট ও ২০০ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।