ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:মঙ্গলবার হকার ইস্যু নিয়ে ঘটে যাওয়া ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
ঘটনা তদন্তে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার মঈনুল হক জানান, একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও র্যাবের একজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর হকার ইস্যু নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এ ঘটনায় বুধবার পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমান ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী। এতে তারা এ ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করেন।
শামীম ওসমানের সংবাদ সম্মেলন : বুধবার বিকালে শহরের চাষাঢ়ায় রাইফেল ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমপি শামীম ওসমান বলেন, ‘ওই ঘটনা শামীম ওসমানের সঙ্গে আইভীর কোনো লড়াই বা ঝগড়ার বিষয় নয়। এটাকে ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন মিডিয়া নিয়াজুল ইসলাম নামে একজনের অস্ত্র হাতে নেয়া ছবি উপস্থাপন করে আমার লোক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।
মেয়র আইভীও দাবি করেছেন, নিয়াজুল তাকে হত্যা করতে পিস্তল বের করেছে।’ কিন্তু বাস্তবে কি ঘটেছে উল্লেখ করে শামীম ওসমান একটি ভিডিও ও কয়েকটি স্থির চিত্র প্রদর্শন করে বলেন, ‘এই ভিডিও গণমাধ্যম কর্মীরাই তুলেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে নিয়াজুল একাই মেয়র আইভী ও তার দলবলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাকে তিন দফা সেখানে মারধর করা হয়েছে। এরপর সে জীবন রক্ষার্থে তার লাইসেন্স করা পিস্তল বের করেছে। এরপর তাকে মেরে পাঁজরের হাড় ভেঙে দেয়া হয়েছে, তার পিস্তলটি ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ প্রশ্ন হল মেয়রকে মারতে কি সে ২-৩শ’ লোকের সামনে একা যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও কয়েকটি স্থির চিত্র দেখিয়ে বলেন, ‘মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু সুফিয়ান কোমর থেকে পিস্তল বের করছেন, বিএনপির ক্যাডার সুমন আইভীকে ঘিরে ধরে হকারদের দিকে পিস্তল তাক করে আছে। শুনেছি মেয়র আইভীর সরকারি দেহরক্ষীও তিন রাউন্ড গুলি ছুড়েছে বলে জিডি হয়েছে থানায়। কিন্তু এসব তথ্য অনেক মিডিয়াতেই আসেনি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমি নিয়াজুলকে ‘ডিফেন্ড’ করছি না। কিন্তু আমার লোক আর আমি মারতে পাঠিয়েছি বলে যে মিথ্যাচার করছেন মেয়র আইভী তার জবাব দিলাম মাত্র।’
তিনি বলেন, নিয়াজুলের আপন বড় ভাই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা নজরুল ইসলাম সুইটকে বিএনপি-জামায়াত আমলে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। ২০০১ সালের পর থেকে নিয়াজুল ঘর ছাড়া। দেশে ফিরে সে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু ভাই হত্যার বিচার পায়নি। অথচ যে বিএনপি-জামায়াত জোট তার ভাইকে হত্যা করেছে তারাই যখন আবার এ আমলে মেয়র আইভীর মতো আওয়ামী লীগ নেত্রীর হয়ে তার ওপর বিনা কারণে আক্রমণ চালায় তখন লজ্জা হয় আমাদের।
শামীম ওসমান বলেন, এ ভিডিও চিত্র প্রশাসনের কাছেও থাকা উচিত। যদি নিয়াজুল অপরাধী হয় তবে তদন্ত করে তার শাস্তি হোক। তার ছিনিয়ে নেয়া পিস্তল বের করে পরীক্ষা করা হোক। মেয়র আইভী কথায় কথায় বলেন, প্রশাসন-পুলিশ সব আমার পরিবারের লোক। অথচ নিয়াজুলের পিস্তল ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় মামলা নিচ্ছে না পুলিশ।
শামীম ওসমান বলেন, নিয়াজুল চাষাঢ়ার স্থানীয় লোক। খবর পেয়ে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন সেখানে ছুটে যান। অথচ তারও মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর সংগঠনের অন্যান্য নেতাকর্মীরা সেখানে ছুটে গেলে তাদের ওপর হামলা করা হয়। একই সঙ্গে পুলিশও উল্টো দলের নেতাকর্মীদের ওপর গুলি ছুড়েছে।
শামীম ওসমান বলেন, এটা আমার সঙ্গে আইভীর লড়াই নয়। এটা হকারের সঙ্গে আইভীর লোকজনের সংঘর্ষ। দলের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরের ফোন পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে থামাতে গিয়েছিলাম। না গেলে অনেকের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠত। আমি যাওয়ার পর সেখানে কোনো ঘটনা ঘটেনি। একটা ইটও পড়েনি। অনেকে হকার ভার্সেস আইভী ইস্যুকে শামীম ভার্সেস আইভী বানাতে তৎপর।
প্রেস ক্লাবের সভাপতিসহ আরও সহযোগী মিলে প্রথমে পাট সমিতির সামনে হকারদের উঠিয়ে দিলেন। তারপর দ্বিতীয় দফা নূর মসজিদের সামনে এলে সেখানেও হকাররা মার খেয়েছেন। আমার কাছে ছবি আছে তারা হকারদের উচ্ছেদ করে তাদের মালামাল পুড়িয়ে দিচ্ছেন। সেখানে আমি দেখলাম আইভীর সঙ্গে কারা ছিলেন, দেখলাম যুবদলের অাহ্বায়ক খোরশেদ। যার নামে দুই ডজন সন্ত্রাসী মামলা। তার সঙ্গে ছিলেন বিভা, যার স্বামী তালিকাভুক্ত বিএনপির সন্ত্রাসী এবং বড় ভাই ডাবল মার্ডার কেসের আসামি। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আইভীর সঙ্গে। কিন্তু তাদের ধরা হচ্ছে না। আর মেয়র কথায় কথায় বলেন, প্রশাসনকে উৎখাত করা হোক। এ নাটক আমরা সবাই বুঝি। আইভী এর আগেও সব ডিসি ও এসপির অপসারণ চেয়েছিলেন।
আইভীর সংবাদ সম্মেলন : নারায়াণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী তার ওপর হামলার ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।
বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ভবনে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
মেয়র আইভী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে হত্যার জন্যই এ হামলা। ঘটনার আগের দিন হকারদের বসার ঘোষণা ও আদেশ দিয়ে হামলা করিয়েছেন শামীম ওসমান। এ হামলায় আমার বোন জামাই, ভাই, কর্মীরা আহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, আমি মার খেতে প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু কর্মীরা মার খাবে আমি কখনোই চাইনি। আমার ধারণা ছিল, আমি ওখানে বসা থাকলে এ হামলা হবে না। কিন্তু হয়েছে। আমার কর্মীদের টার্গেট করে মারা হয়েছে।’
মেয়র আইভী বলেন, ‘আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে হাজার হাজার মানুষ আসেন। কাউকে ডেকে আনিনি, আমি তো অস্ত্র নিয়ে মিছিলে যাইনি। সেলিম ওসমান আমাকে চিঠি দিয়েছেন, আমি সেলিম ওসমানের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, চিঠি দিয়েছি।
যেখানে প্রশাসন বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে কেন এমন হামলা প্রশ্ন করে আইভী বলেন, অন্য আসনের এমপি কেন হকার নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু করলেন। এ আসনের এমপি তো সেলিম ওসমান। শহরে হকার বসবে কি বসবে না তা স্থানীয় এমপিসহ আমি, ডিসি, এসপি বুঝব। এখানে তো উসকানি দেয়ার কিছু নেই।’
তিনি বলেন, ‘চাষাঢ়া হকার্স মার্কেট করে দিয়েছি। প্রয়োজনে সেই মার্কেট ১০ তলা করার পরামর্শ দিয়ে শামীম ওসমান আমাকে সহযোগিতা করার কথা বলতে পারত। কিন্তু তা না করে তার লোক দিয়ে হামলা করাল। এখন হামলার ঘটনা হকারদের ওপর চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে শামীম ওসমান। তিনি বলতে চাচ্ছেন, হকারদের সঙ্গে আইভীর লোকজনের সংঘাত হয়েছে। তাহলে নিয়াজুল কে? সে কার লোক? তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে।’
আইভী বলেন, ‘আমাকে মারত। তাতে কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু চোখের সামনে নেতাকর্মীরা মার খেয়ে আমাকে রক্ষা করল। তারা প্রচণ্ড মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছে। অথচ আমি আমার কর্মীদের মারধর থেকে বাঁচাতে পারিনি। এটা আমার কাছে অনেক দুঃখের, অনেক কষ্টের।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় এক থেকে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হয়েছেন। আর পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টি দেখেছে। আমার কর্মীরা তো নিরস্ত্র ছিল, কেন তাদের ওপর এ ন্যক্কারজনক সশস্ত্র হামলা চালানো হল?’
১৮জানুয়ারী,২০১৮বৃহস্পতিবার::ক্রাইমর্বাতা.কম/প্রতিনিধি/আসাবি