স্টাফ রিপোর্টার : আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এ সময় শিক্ষার্থীদের লোহার রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছে। এর আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস. এম. জাকির হোসাইন ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসানের নেতৃত্বে একদল নেতাকর্মী ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের করে নেন। এ দিকে হামলায় কথা অস্বীকার করে উল্টো আন্দোলনকারীদের বিচার চাইলেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর থেকে নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থাকার পর বিকালে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ২০-২৫ জনের একটি দল তাকে মুক্ত করতে এগিয়ে যায়। ভিসিকে উদ্ধারে আন্দোলনকারীদের উপর কয়েক দফায় হামলা চালিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র মাসুদ আল মাহাদী, ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের প্রগতি বর্মনকে মারধর করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল শাখার নেতাকর্মীরা। রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে গত ১৫ জানুয়ারির আন্দোলন কর্মসূচিতে ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের ‘নিপীড়নের’ প্রতিবাদে বর্তমানের ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। অধিভুক্তি সমস্যার সমাধান ছাড়াও নিপীড়নে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহিষ্কার ও প্রক্টরের অপসারণসহ চার দফা দাবিতে গত সপ্তাহ থেকে এই আন্দোলন চালিয়ে আসছে তারা। গতকাল দুপুর ১২টায় ভিসি কার্যালয়ের সামনে এসে অন্তত তিনটি ফটক একে একে ভেঙে বেলা দেড়টার দিকে ভিসির দরজার সামনের করিডোরে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তিন ঘণ্টার বেশি অবরুদ্ধে থাকার পর বিকাল সোয়া ৩টার দিকে বোর্ড অব এডাভান্সড স্টাডিজের একটি সভায় অংশ নিতে সিনেট ভবনে যেতে নিজের কার্যালয়ের পেছনের ফটক দিয়ে বের হন ভিসি; পথে ভিসির চারপাশ ঘিরে অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র মাসুদ আল মাহাদী ভিসির কাছে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরে তা পূরণের দাবি জানান। জবাবে ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর মধ্যেই বেলা পৌনে ৪টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ ছাত্রলীগের ২০-২৫ জন নেতাকর্মী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তারা ভিসিকে মুক্ত করে ফের তার কার্যালয়ে নিয়ে যান। এসময় ভিসির কক্ষের সামনের করিডোরে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রড নিয়ে তাড়া করে কয়েকজনকে মারধরও করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এরপর কিছুক্ষণের জন্য অবরোধকারীদের ভিসির দরজা সামনে রেখে সরে গেলেও বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এসে লোহার রড ও লাঠিশোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থানে হামলা চালায়। হামলার পর ভিসি কার্যালয় থেকে সিনেট ভবনের দিকে যাওয়ার ফটক দিয়ে চলে যেতে চাইলেও সেখানে আরেকদল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হামলার শিকার হয় আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করলে প্রশাসনিক ভবনের ভেতর দিয়ে মূল ফটক হয়ে বেরিয়ে যেতে চান আন্দোলনকারীরা। কিন্তু ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া করে আন্দোলনকারীদের মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ হামলায় প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট-এর ঢাবি শাখা সভাপতি ইভা মজুমদার বলেন, আমরা নিপীড়নদের বিচারের দাবিতে এসেছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ সময় আমাদের ১২ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানান তিনি। আন্দোলনকারীদের বিচার চাইলেন ছাত্রলীগ সভাপতি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা অস্বীকার করে উল্টো তাদের ওপর দায় চাপালেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। গতকাল বিকেলে মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আন্দোলনকারীদের বিচার দাবি করেন। সোহাগ বলেন, আন্দোলনকারীরা আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। তারা ভিসির ওপর হামলা করেছে। ভাঙচুর চালিয়েছে। আমরা তাদের বিচার চাইছি ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের জোর দাবি জানাচ্ছি। এ সময় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, আন্দোলনকারীরা নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। শারীরিকভাবে নিপীড়ন চালিয়েছে। তিনি মোবাইলে ছবি দেখিয়ে বলেন, বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনে লিড দিয়েছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থী হয় কি করে? অবশ্য তার কিছুক্ষণ আগেই আবিদ দাবি করেন, আন্দোলনকারীরা জঙ্গি কায়দায় হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে। তাদের মধ্যে শিবির ছিল। প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনসহ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃবৃন্দ। কোন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি: বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী দাবি করেছেন, প্রক্টর অফিস থেকে কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেই কোনো মামলা করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের ৪ দফা দাবি ও তা না মানার বিষয়ে ঢাবি উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তাদেরকে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। অবশ্য ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে প্রক্টর বলেন, প্রক্টর অফিস থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে রয়েছে- অধিভুক্ত ৭ কলেজ বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও যৌন নিপীড়নকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বহিষ্কার, প্রশাসনের করা নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ প্রক্টরের পদত্যাগ। এর আগে গত রোববার তিন দফা দাবি আদায়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়ায় আজ আবারও আন্দোলনে নেমেছেন তারা।
২৪জানুয়ারী,২০১৮মঙ্গলবার:ক্রাইমর্বাতা.কম/প্রতিনিধি/আসাবি