ঢাকা: বাংলাদেশে এক সময়ের দেশ কাঁপানো যে ছাত্রনেতারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতেও আলোড়ন তুলেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না তাদের একজন।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের এই তুখোড় বামপন্থী ছাত্র নেতা পরবর্তী জীবনে বার বার দল এবং মতাদর্শ বদলে অবশ্য অনেক বিতর্কেও জড়িয়েছেন।
রাজনীতিতে তার দীক্ষা হয়েছিল একেবারে কিশোর বয়সেই।
‘আমার মেজ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, অর্থনীতিতে। উনি রাজনীতি করতেন। বাসায় আমাদের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো, চর্চা হতো। এসব শুনতে শুনতে কিশোর বয়সেই আমি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠি।’
মাহমুদুর রহমান মান্নার বাড়ি বগুড়ায়, সেখান থেকে ঢাকা আসেন গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে।
‘আমি এসএসসি পাশ করেছি ঢাকার আরমানিটোলা সরকারী হাই স্কুল থেকে। আমি ৬৪ থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়েছি।’
স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই মাঝে মধ্যে চলে যেতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। যোগ দিতেন আমতলায় বা ক্যাম্পাসের অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সভায়। এই যাওয়া আসা করতে করতেই আগ্রহী হয়ে গেলেন রাজনীতিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন তখন উত্তাল হতে শুরু করেছে।
কলেজ পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ততদিনে মাহমুদুর রহমান মান্না ছাত্রলীগের এক তেজস্বী নেতায় পরিণত হয়েছেন।
ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ১৯৭২ সালে ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচনেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশে তখন ছাত্রলীগে ভাঙ্গনের সুর স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙ্গেনি। একটি অংশ ‘মুজিববাদের’ অনুসারী। অপর অংশ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের।’
‘চাকসু নির্বাচনে দুটি প্যানেল হয়েছিল। ছাত্রলীগের মধ্যেই। আমি জিএস পদে দাঁড়িয়েছিলাম। এবং আমাদের প্যানেল থেকে চারটি পদ জিতেছিলাম। বাকীগুলো সব পেয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন।’
এরপর ছাত্রলীগ ভেঙ্গে গেল আনুষ্ঠানিকভাবে। মাহমুদুর রহমান মান্না চলে গেলেন জাসদের অনুসারী ছাত্রলীগে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন প্রচন্ড অস্থির সময়। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাসদ মারমুখী ভূমিকায়।
জাসদের সেদিনের রাজনৈতিক ভূমিকা বা কৌশল নিয়ে এখন অবশ্য মাহমুদুর রহমান মান্নার মনে অনেক প্রশ্ন।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবনের সামনে গোলাগুলিতে মারা গেলেন জাসদের বেশ কয়েকজন কর্মী। গ্রেফতার হয়ে গেলন সংগঠনের অন্যতম নেতা আ স ম রব এবং আবদুল জলিল। সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়ে জাসদ চলে গেল আধা গোপন রাজনীতিতে। গণবাহিনী গঠন করা হলো।
‘ওটা সম্পূর্ণ একটা ভুল পদক্ষেপ ছিল। যেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। এই ভুলের খেসারত দিতে দিতেই তো জাসদ এখন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।’
কিন্তু এই উপলব্ধি অনেক পরের। তার আগে মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বহু বছর বাংলাদেশের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
পর পর দুবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রথম ১৯৭৯-৮০ সালে। দ্বিতীয় বার ১৯৮০-৮১ সালে আবার। এবং দুবারই বাংলাদেশের অন্যান্য প্রধান দলের ছাত্র সংগঠনগুলোকে হারিয়ে।
তার এই বিজয়ের পেছনে রাজনৈতিক আদর্শবাদ নাকি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, কোনটি বেশি কাজ করেছিল?
‘এখন আমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এবং জনপ্রিয়তা হয়তো বেশি কাজ করেছে। যদিও বাম রাজনীতিতে আমরা বলতাম, এগুলো কোন বিষয় নয়। কিন্তু এখন আমার মনে হয় এগুলো কাজ করে।’
‘আমার ধারণা ছিল আমি এভারেজ বক্তৃতা করতাম। কিন্তু এখন আমার মনে হয় আমার বক্তৃতা পছন্দ করতেন সবাই। আমি মেঠো বক্তৃতা দিতাম না। সেসময় রাজনীতিতে বক্তৃতা মানেই হচ্ছে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বক্তৃতা। গরম গরম কথা বলা। আমি এরকম করিনি কখনো। আমি মাঠের ব্ক্তৃতা করতে পারি না, ব্যাপারটা এরকম নয়। আমি যেরকম বক্তৃতা করতাম, একটু কন্স্ট্রাক্টিভ, একটু সফিস্টিকেটেড। এটা হয়তো মধ্যবিত্ত ছাত্র, যুবকরা পছন্দ করতো।’
তুখোড় ছাত্রনেতার তকমাটা তার গায়ে লেগে গেলেও মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে তুখোড় হচ্ছেন অন্যরা।
‘তুখোড় ছাত্র নেতা বলতে কি বোঝায়? তুখোড় ছাত্রনেতা বলতে আসলে বোঝায় আসম রব, তোফায়েল আহমেদ, নুরে আলম সিদ্দিকী- ওদের। ওরা একেবারে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটাই ভেঙ্গে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পতাকা তুলেছেন। স্বাধীনতার মন্ত্র দিয়েছেন।’
সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাজনীতি যে বাংলাদেশে চলবে না, সেটা তিনি বুঝতে শুরু করেন আশির দশকের মাঝামাঝি এসে।
‘রাশিয়ায় তখন গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রেইকা নিয়ে হৈ চৈ চলছে, তখন বিশ্বব্যাপী একটা আলোড়ন হচ্ছে। বাংলাদেশে আমাদের বিভিন্ন বাম দলের মধ্যেও কথাবার্তা হচ্ছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, এই আদর্শ বাংলাদেশে আর চলবে না।’
কিন্তু যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জাসদের রাজনীতির শুরু, সেই আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন কিভাবে? মাহমুদুর রহমান মান্না জানালেন শেখ হাসিনাই তাঁকে ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বলেছিলেন।
‘তখন আমি বাম রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। জাসদ-বাসদ ছেড়ে দিয়েছি। কী করবো। বসে আছি। তখন একদিন শেখ হাসিনা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ওবায়দুল কাদের আমার একই সময়ের ছাত্র নেতা। আমরা বন্ধুও বটে। তার মাধ্যমে ডেকে পাঠালেন। শেখ হাসিনা আমাকে বললেন, দেখেন, আমিতো সমাজতন্ত্র করি না, করবোও না। তখনও উনি আমাকে আপনি করে বলেন। বললেন, আমি সমাজতন্ত্র পর্যন্ত যাব না। কিন্তু জনগণের কল্যাণের প্রোগ্রামে তার কাছাকাছি যাব।’
এরপর আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
‘সে সময়ে আমার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগই ভালো দল। কোন বাম দলে যেহেতু যাব না, আমি মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে চেয়েছি।’
২০০৭ সালে বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হলো, তখন যাদের নিয়ে রাজনীতিতে নানা ধরণের কানা-ঘুষো চলছিল, মাহমুদুর রহমান মান্না তাদের একজন।
সেনা শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়নে তিনি সায় দিয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ, সে ব্যাপারে তার বক্তব্য কী?
‘এই অভিযোগ আমার কাছে হাস্যকর লাগে। ওয়ান ইলেভেনের ঐ ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ায় যারা যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের কারও সঙ্গেই আমার কোন কথাই হয়নি, তাদের আমি ভালো করে চিনিও না।’
‘এই প্রচারটা আমার নামে করা হয়েছে, আমাকে যখন আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন। আমাকে সরানোর পক্ষে কোন যুক্তি তো ছিল না। অতএব তারা বলেছেন, আমি ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছি।’
আওয়ামী লীগ ২০১০৪ সালের ৫ই জানুয়ারী যেভাবে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে, সেটিকে দলের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের একেবারে পরিপন্থী বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
‘আমি এখনো সব জায়গাতেই বলি, ওটা কোন নির্বাচন হয়নি। একটা দল, যাদের এত বছর ধরে সংগ্রাম, আন্দোলনের ইতিহাস আছে, তারা এরকম একটা কাজ করবে, তারপর যদি বলে এটাই কারেক্ট, তার সঙ্গে আমি যেতে রাজী নই।’
কিন্তু তার বিরুদ্ধেই তো এখন অভিযোগ তোলা হচ্ছে তিনি নিজেই অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আনার ষড়যন্ত্র করছিলেন। বিশেষ করে তাঁর ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপগুলোর ব্যাপারে কি বলবেন তিনি?
‘এই টেলিফোন কথোপকথন, এটা তো আপনাদের কাছে থাকবার কথা। ইউটিউবে তো আছে। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, বা তারা যেটা তুলেছেন, সরকারই তো মামলাটা দিয়েছে। সেই অভিযোগের স্বপক্ষে তারা তো একটা চার্জশীটও করতে পারেননি। তিন বছর বা তার বেশি হয়ে গেছে। আপনার শুনে দেখুন, এর মধ্যে অভিযোগ গঠনের মতো কিছুই নেই।’
ঢাকার সাবেক মেয়র এবং বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে টেলিফোন আলাপটি সম্পর্কে তার ব্যাখ্যাটা এরকম:
‘আমি বাংলাভিশনে তখন একটা টক শো হোস্ট করি। বাংলাভিশনের অন্যতম মালিক সাদেক হোসেন খোকা। উনি আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কথা বলতেন। আমি প্রোগ্রাম করে বেরিয়েছি, উনি প্রায় দিন রাতের বেলা আমেরিকা থেকে ফোন করতেন। তখন আমেরিকায় ছিলেন। বিভিন্ন-রকম কথা হতো। অনেকদিনই কথা হয়েছে। তার মধ্যে একটা কথা ওরা ধরেছেন।’
‘যেটা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে, সেটাও যদি এখন বাজিয়ে শোনা হয়, উনারা যে অভিযোগ করেছেন, তার কিছু্ই পাবেন না ওর মধ্যে। বলা হয়েছে, মাহমুদুর রহমান মান্না লাশ চায়। অথচ পুরো কনভারসেশনে লাশ শব্দটা পর্যন্ত নেই। আমি আপনাকে বলছি, আপনি নিজে শুনে দেখুন যদি সুযোগ থাকে। ওর মধ্যে লাশ, বা লাশ ফেলবো এরকম কোনো কথা নেই।’
আওয়ামী লীগ ছেড়ে মাহমুদুর রহমান এখন নাগরিক ঐক্য বলে যে সংগঠনটা গড়েছেন, সেটা আসলে কি? নাগরিক ঐক্যের রাজনীতিটা কি?
মাহমুদুর রহমান সেই উত্তরটাই দিলেন, গত কয়েক দশকে বহু বার বহু রাজনীতিক তাদের নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার সময় যা বলেছিলেন।
‘দেশের প্রচলিত রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নে ভরা। বড় দুটি দল, যারা এই রাজনীতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তারা একই মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই দুই দলের বাইরে তাই একটা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। আমি সেটাই চাই।’
কিন্তু যাদের সঙ্গে মিলে তিনি রাজনীতিতে এই তৃতীয় স্রোত তৈরির চেষ্টা করছেন, তাদের বেশিরভাগকেই তো অনেকে বর্ণনা করবেন ‘ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিক’ হিসেবে। এদের নিয়ে কী রাজনীতিতে তৃতীয় স্রোত তৈরি করা যাবে?
মাহমুদুর রহমান মান্নার অকপট স্বীকোরোক্তি, ‘এর বাইরে তো আর লোক নেই। যারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সঙ্গে আছে, তাদের কাছে তো একথা বলে লাভ নেই। এর বাইরে যারা আছেন, যারা মনে করছেন যে এরকম কিছু করতে হবে, আমাকে তো তাদের কাছেই যেতে হবে।’