ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:চীনে বিয়ের জন্য পাত্রী পাচ্ছে না, প্রতি ৬ জনের একজন পুরুষ। চীনে মেয়ের সংখ্যা এতোটাই কমেছে যে ১৬ ভাগ পুরুষ বিয়ের জন্য পাত্রী পাচ্ছে না। এছাড়া বিয়েতে পাত্রীকে দিতে হয় অন্তত ৭৫ হাজার ডলার যা বাংলাদেশের প্রায় ৬২ লাখ টাকা। আর এই টাকার যোগাড় করা অনেক পুরুষের পক্ষেই অসম্ভব। পাশাপাশি বিত্তশালীদের খপ্পরে পড়ে ভাঙছে বিবাহিতদের ঘর। সব মিলিয়ে চীনে পুরুষদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং পাশাপাশি বেড়েছে হতাশাও।
প্রচলন আছে ছেলে বংশের বাতি আর মেয়ে সংসারের বোঝা, তবে এমন ধারণা অর্থহীন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনে। এক সন্তান নীতির কারণে গত ৪ দশক ধরে গর্ভেই নষ্ট করা হতো মেয়ে শিশুর ভ্রুণ। যার ফলে দেশে মেয়ের সংখ্যা এতোটাই কমেছে যে ১৬ ভাগ পুরুষ বিয়ের জন্য পাত্রী পাচ্ছে না। এছাড়া বিয়েতে পাত্রীকে দিতে হয় অন্তত ৭৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৬২ লাখ টাকা। আর এই টাকার যোগাড় করা অনেক পুরুষের পক্ষেই অসম্ভব।
চীনের পুরুষেরা বলেন, নারীর মন ¯্রষ্টাই বুঝতে পারে না। এখনতো অবস্থা অনেক করুণ। কারণ এই নিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা চলছে। ৬ বছরের প্রেম উপেক্ষা করে আমার প্রেমিকা বিয়ে করে বৃত্তশালী একজনকে।
আবার একটি চক্র বিবাহিত নারীদের প্ররোচিত করে চলে যেতে সাহায্য করছে বিত্তশালীদের কাছে। পাশাপাশি বেড়েছে নারী অপহরণ এবং পাচারের ঘটনাও।
আর চীনের নিরাপত্তাবাহিনী বলেন, এই পর্যন্ত প্রায় ৩৩ হাজার নারীকে উদ্ধার করেছে তারা।
তুলনামূলকভাবে কম মেধার মেই এইকাই মাধ্যমিক শেষ করেই চলে গিয়েছিলেন ইউক্রেনে। অথচ এর আগে দেশটি সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। ভাবতেন, অবস্থান হয়তো আফ্রিকা মহাদেশে আর ভাষা সম্ভবত ফ্রেঞ্চ কিংবা স্প্যানিশ। ওই দেশে ১২ বছর পড়াশোনার পর গত বছরের শেষ দিকে চীনে ফেরত আসেন এই মেই এইকাই। অবশ্য একা আসেননি, সঙ্গে ছিল তার ইউক্রেনীয় স্ত্রী আর ফুটফুটে ছেলে। খবরটি ছবিসহ বেশ ফলাও করে ছেপেছিল চীনের একটি পত্রিকা। এর কয়েক দিন পরেই আরেকটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কার্টুন, যার নিচে লেখা ছিল— ‘কোনও সমস্যা নেই, চীনের কনে সংকটের সমাধান করবে ইউক্রেন’। রাষ্ট্র পরিচালিত বেইজিং নিউজ সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, চীনা নারীদের ঘাটতির সমাধান হতে পারে ইউক্রেনের নারীরা। বলার অপেক্ষা রাখে না সেখানে পুরুষদের চেয়ে নারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি। পক্ষান্তরে চীনে বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ পার্ক কিংবা অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রে একাই ঘুরছেন এমন ছেলের সংখ্যা কম নয়।
চীনে মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়াতেই এমন সব রসিকতা। প্রতি ১০০ মেয়ের বিপরীতে ছেলেদের বৈশ্বিক গড় যেখানে ১০৫, সে জায়গায় চীনে ১০০ মেয়ে শিশুর বিপরীতে জন্ম নিচ্ছে ১১৫টি ছেলে শিশু। চীনের কঠোর পরিবার পরিকল্পনা নীতির সঙ্গে সনোগ্রাম প্রযুক্তি যুক্ত হয়েই এ সমস্যাটিকে জটিল করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ শহুরে পরিবারের একটির বেশি সন্তান গ্রহণের অনুমোদন নেই। জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে দমিয়ে রাখতেই এমন ব্যবস্থা। ঐতিহ্যগতভাবে চীনে ছেলে শিশুদের কদর বেশি। যে কারণে লিঙ্গ নির্বাচিত গর্ভপাত প্রত্যাশিত মাত্রায় কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। আর এসবেরই ফল হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে বিশ্বের সবচে’ জনবহুল দেশটিতে। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো গত মাসের ২০ তারিখ যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সাল শেষে পুরুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭৭১ মিলিয়ন, আর নারী আছে ৬৬৭ মিলিয়ন। অর্থাত্ ৩৪ মিলিয়ন নারীর ঘাটতি রয়েছে সেখানে।
সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে চীনা সরকার নীতিবাক্য আওড়ানোর পাশাপাশি মেয়েদের গুণকীর্তন প্রচার করছে জোরেশোরে। এর পাশাপাশি একটি মাত্র মেয়ে থাকা (ছেলে নেই এবং ভবিষ্যতে আর কোন সন্তান নেবে না) বাবা-মাদের আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। অনেকে আবার তা গ্রহণও করছে। এতে করে মেয়ে শিশুর সংখ্যা কিঞ্চিত বেড়েছে। তবে তা মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়। চীনে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশন গত ২১ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছিল, পৃথিবীর যে কয়টি দেশ লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা নিয়ে বিরাট সমস্যার মুখোমুখি, তার মধ্যে চীন রয়েছে এক নম্বরে এবং সেখানে এ সমস্যা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন করে। বিয়ের জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কপালে স্ত্রী জুটছে না, চীনে এমন লোকের সংখ্যা একবারে কম নয়। এসব দেখে বেইজিংয়ের এক পরিসংখ্যানবিদ ব্যাঙ্গ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, আর বিলম্ব নয়, কালই আমি আমার ছেলেকে বলব তার প্রাথমিক স্কুল থেকে একজন গার্লফ্রেন্ড খুঁজে নিতে। ভবিষ্যতে সে বিপদে পড়ুক, এটি মোটেই কাম্য নয় আমার।
এমনিতেই চীনে নারীরা সংখ্যালঘু, তার ওপর চীনা মেয়েরা অন্য দেশের ছেলেদের বিয়ে করে দেশ ছাড়ছে। বিশেষত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা চীনা নারীদের বিয়ে করার ব্যাপারে ব্যাপক উত্সাহ দেখায়। অবশ্য এর উল্টো চিত্রটাও রয়েছে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক নারীই স্বামী হিসেবে বিদেশিকে বেছে নিতে চায়। ২০১২ সালে এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, এমন নারীদের ২৬ শতাংশেরই প্রথম পছন্দ চীনা পুরুষ। গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার টেলিভিশন অভিনেত্রী পার্ক চাই রিম ও চীনা অভিনেতা বো জাও জিকি’র মধ্যে বিয়ে হয়েছিল বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে। অতএব চীনা পুরুষদেও খুব বেশি হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজ দেশের মেয়ে কপালে না জুটলে আশপাশের দেশগুলোয় গিয়ে একটু চেষ্টা-তদবির করলেই গাঁটছড়া বাঁধার সুযোগ হয়ে যায়।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ের অধ্যাপক থিরেস হেসকেথ সম্প্রতি চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে কে কন্যাভ্রূণ হত্যার বিষয়টিকে সমর্থন করে? বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই এতে হাত তুলেছিল। হেসকেথের বিশ্বাস, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণেই এমনটি ঘটছে। এ সমস্যা এশিয়ার আরেক বৃহত্ রাষ্ট্র ভারতেরও। চীন ও ভারত উভয় দেশেই লিঙ্গ নির্বাচিত গর্ভপাত নিষিদ্ধ। সনোগ্রাম করালেও গর্ভের শিশুটি ছেলে না মেয়ে তা বলা অপরাধ। তা সত্ত্বেও লিঙ্গ নির্বাচিত গর্ভপাতের ব্যবসা জমজমাট। যে কারণে এ দুই দেশেই পাত্রী সংকট জটিল আকার ধারণ করছে। লিঙ্গ নির্বাচন ও পাত্রী সংকটের সম্পর্ক নিবিড়।
২৬জানুয়ারী,২০১৮ শুক্রুবার:ক্রাইমর্বাতা.কম/প্রতিনিধি/আসাবি