রাজনীতিতে উত্তাপ খালেদা জিয়ার ‘রায়’ কেন্দ্র করে হুঁশিয়ারি পাল্টা হুঁশিয়ারি

স্টালিন সরকার : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার ‘রায়’ উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। পাল্টাপাল্টি হুঁশিয়ারি এসেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে। ৮ ফেব্রæয়ারি রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হওয়ার অনেক আগেই একজন প্রতিমন্ত্রী ‘১৫ দিনের মধ্যে বেগম জিয়া জেলে যাবেন’ মন্তব্য সর্বমহলে তোলপাড় সৃষ্টি করে। অস্থায়ী বিশেষ আদালতে মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির চেষ্টা এবং প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বেগম জিয়ার মামলা রায় পূর্বনির্ধারিত। এই অবৈধ সরকার আগেই রায় লিখে রেখেছে। বিচার হবে প্রধানমন্ত্রী যা চাইবেন তাই’। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি মহাসচিবের বক্তবের পাল্টা জবাবে বলেছেন, মির্জা ফখরুল সাহেব কী করে জানলেন মামলার রায় কী হবে? আদালত খালেদা জিয়াকে সাজা দেবেন এ রকম নিশ্চয়তা তাকে কে দিলো?
নেতিবাচক রায় হলে মাঠের নামার ইঙ্গিত দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল বলেছেন, দলের চেয়ারপারসনের মামলায় ‘নেতিবাচক’ কোনো রায় হলে তার পরিণতি ‘ভয়াবহ’ হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে দেশে আবার জ্বালাও-পোড়াও হলে বিএনপিই তাতে পুড়ে ‘ছারখার হয়ে যাবে’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, রায় ঘিরে কেউ ‘বিশৃঙ্খলা বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের’ চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি এই বক্তব্যের মধ্যেই শনিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন সরকারের নেতৃত্বাধীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও একধিক মামলা করা হয়। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো তুলে নেয়া হলেও বিএনপির চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে করা মামলা বহাল থাকে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা এই মামলার তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত অভিযোগ গঠন করে খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। আলোচিত এ মামলায় দুদক ও আসামিপক্ষ মোট ১৬ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। মোট ২৩৬ কার্যদিবস শুনানির পর মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। মামলার অভিযোগে বলা হয়Ñ বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। মামলার দ্রæত নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রথম থেকেই বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ‘অন্তঃসারশূন্য’ এই মামলাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই মামলা দ্রæত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছে।
শুধু তাই নয়, মামলার যুক্তিতর্ক চলার সময় সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এমন সব মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে মামলা প্রভাবিত হতে পারে বলে অভিযোগ করেন। অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রথম থেকেই বিএনপি নেতাদের অভয় দিয়ে বলেছেন, রায় দেবে আদালত। রায়ের ব্যাপারে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব-উল আলম হানিফ কয়েকদিন আগে বলেছেন, বেগম জিয়া আদালতের রায়ের মাধ্যমে বেকসুর খালাস হয়ে আসুক এটা আমরা চাই। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় গুলশানের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ম্যাডাম (খালেদা জিয়া)। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের কয়েকমাস আগে এই রায় সামনে রেখে শনিবারের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। রায়ের পর কি কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে সে সব বিষয় বৈঠকে চ‚ড়ান্ত হবে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবীরাও নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলার ‘রায়কে’ অত্যন্ত স্পর্শকাতর মনে করছেন। তাদের আশঙ্কা, এ মামলায় যে রায়ই হোক না কেন, সেটা রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়াবে। কারণ বিএনপি আগেই ঘোষণা দিয়েছে ‘নো খালেদা জিয়া, নো ইলেকশন’। অন্যদিকে ৫ জানুয়ারির মতো আবার একটি বিতর্কিত নির্বাচন করা সরকারের জন্য কঠিন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল এক টিভি টকশোতে বলেছেন, এ ধরনের মামলা আগামী দিনের রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রচÐ প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অযোগ্য হন, তা আগামীতে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলবে। তবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসেইন বলেন, সরকারের ইচ্ছার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। সরকার যদি চায় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হবে, তাহলে পরিস্থিতি হবে এক ধরনের। সেটা না চাইলে পরিস্থিতি হবে অন্য ধরনের। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির প্লেয়ার শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নয়; দেশের বাইরেরও অনেক শক্তি রয়েছে। তারা কি করবে সেটার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচনের পরিবেশ কেমন হবে। তবে সরকারের হাত অনেক লম্বা।
আরাফাত রহমান কোকোর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নাগরিক অধিকার আন্দোলন ফোরাম’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যে বক্তব্য দেন, তাকে স্পষ্ট বিএনপি ৮ ফেব্রæয়ারির সম্ভাব্য রায় জানার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘৮ ফেব্রæয়ারি যেটা আমরা আশঙ্কা করছি, সেদিন ‘নেতিবাচক’ কোনো সিদ্ধান্ত সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে প্রকাশ পায়; তাহলে তখন থেকে এই সরকারের পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে।’ সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সময় বলে দেবে, কে নেতৃত্ব দেবে, আর কে রাজপথে থাকবে। সরকারকে বলব জেলের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বর্তমানে সারাদেশই তো কারাগার। আমরা খালেদা জিয়ার সাথে বৃহত্তর কারাগারেই আছি। আমরা সবাই খালেদা জিয়ার জেল পার্টনার। ৮ ফেব্রæয়ারির রায় ঘিরে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি না দিলেও তিনি বলছেন, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু করার ঘোষণা দেই বা না দেই, এমন কিছু বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না।
একই সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদের সুরেও ছিল পাল্টা হুঁশিয়ারি। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখলাম, তারা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার যদি শাস্তি হয়, তবে নাকি দেশে আগুন জ্বলবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব, রিজভী সাহেব ও বিএনপির নেতাদের বলতে চাই, আপনারা দেশে অতীতেও আগুন জ্বালিয়েছেন। সেই আগুনে আপনারা জ্বলেছেন। আবারো আগুন জ্বালানের চেষ্টা করলে সেই আগুনে আপনারাই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন।’ হাসান মাহমুদের ভাষায়, খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন আদালত ‘স্বাধীন ছিল না’ বলেই বিএনপি নেতারা মনে করেন সরকারের ইচ্ছায় রায় হয়। তাদের ধারণা, বিএনপির সময়ে আদালত যেভাবে কাজ করত; এখনো সেভাবেই কাজ করে। এখন আদালত স্বাধীন। খালেদা জিয়া হয়তো খালাসও পেতে পারেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে চলছে; তখন ‘একটি চক্র’ দেশকে অস্থিতিশীল করার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা, খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়া-আসার ঘটনা, মির্জা ফখরুলের বক্তব্য, রিজভী আহমেদের বক্তব্য সবগুলো একই সূত্রে গাঁথা। ৮ ফেব্রæয়ারি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহŸান জানিয়ে হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়ার বিচারের রায় হবে। দেশে বিশৃঙ্খলা চালানোর অপচেষ্টা করা হবে। সরকারি দলের নেতাকর্মী হিসেবে জনগণের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। জনগণকে সাথে নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পেট্রল বোমা বাহিনীকে প্রতিহত করতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এদিকে দুই পক্ষের হুঁশিয়ারি-পাল্টা হুঁশিয়ারির মধ্যে গতকাল ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আগামী ৮ ফেব্রæয়ারি এই রায় ঘিরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পেশাদার এবং জনগণের বন্ধু। জনগণের ক্ষতি হলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী রাজপথে নামার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলা দেয়া হয়েছে। এ মামলার সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জাল নথি, অসথ্য তথ্য, বানোয়াট অভিযোগ দাখিল করে মামলাটি করা হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বিচারক যদি মামলার রায় এজলাস ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় করে থাকে, সেটি রাজনৈতিকভাবে ও আইনিভাবে মোকাবেলা করা হবে। সরকারের অশুভ কোনো ইচ্ছা পূরণ হতে দেয়া হবে না।ইনকিলাব

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।