মাদরাসা শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেয়া হোক

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:    এ এক অভূতপূর্ব, অনন্য, মহাসম্মেলন। মাদরাসা শিক্ষকদের একক ও সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উদ্যোগে গত ২৭ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এ মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন দেশের সব আলিয়া মাদরাসা প্রিন্সিপাল, সুপার, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও পীর-মাশায়েখ। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সম্মেলন উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও জাতীয় সংসদের ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন এমপি। দুই লক্ষাধিক আলেম ও শিক্ষকের এই মহাসম্মেলন এক মহাজাগরণের সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে। এ ধরনের মহাসম্মেলন বিরল ও ব্যতিক্রমী। মাদরাসা শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আয়োজিত এ মহাসম্মেলনে উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম দাবি তোলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য চলবে না। আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষকদের বঞ্চিত রেখে উন্নয়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্থবহ হতে পারে না। ইবতেদায়ী থেকে কামিল পর্যন্ত সব মাদরাসার শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। তাদের এই বক্তব্য ও দাবি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত। এ দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, আপনারা চাকরি জাতীয়করণের যে দাবি জানিয়েছেন আমি তার সঙ্গে একমত। তবে এটা আমার হাতে নেই। আমি আপনাদের কর্মী হিসাবে আপনাদের দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবো। আশা করি, তিনি বিবেচনা করবেন। সালমান এফ রহমান আশা প্রকাশ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী আগের মত এবারও আপনাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাবেন। বজলুল হক হারুন এমপি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শিক্ষকদের দাবি করার প্রয়োজন নেই। অতীতে অনেক কিছু দাবি করার আগেই তিনি দিয়ে দিয়েছেন। মাদরাসা শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের দাবি পুরণ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী মাদরাসা শিক্ষকদের যে চার দফা দাবি মহাসম্মেলনে তুলে ধরেছেন তা বস্তুত তাদের প্রাণের দাবি। এই দাবিকে উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। চাকরির ক্ষেত্রে, সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হবেন, তা হতে পারে না। একমাত্র তাদের চাকরি জাতীয়করণের মাধ্যমেই এই বৈষম্যের অবসান হতে পারে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ইবতেদায়ী মাদরাসার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে বিরাট বৈষম্য। সরকারী প্রাইমারী স্কুলের সমমর্যাদা প্রদান এবং এর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও টিফিনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমেই এ বৈষম্য দূর হতে পারে। মাদরাসা শিক্ষা সভ্য ও সুনাগরিক গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। মেধার দিক থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা কোনো দিক দিয়েই ন্যুন নয়। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলেই তার প্রমাণ রয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের ফলে এখন এর শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমান তালে প্রতিযোগিতা করছে, কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছে। সততা, সত্যবাদিতা ও উন্নত চারিদিক গুনাবলীর দিক দিয়ে মাদরাসা শিক্ষিতরা অবশ্যই এগিয়ে আছে। এক সময় বলা হতো, মাদরাসা শিক্ষা পশ্চাদপদ শিক্ষা, এর কোনো ভবিষ্যত নেই। এখন সে কথা অচল। এক শ্রেণীর ইসলাম বিদ্বেষী মাদরাসাকে জঙ্গীবাদের ঘাঁটি বলতে উৎসাহ বোধ করে। অথচ এর চেয়ে মিথ্যাচার আর কিছু হতে পারে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, যারা বুকে ও মাথায় কোরআন ধারণ করে তারা জঙ্গী হতে পারেনা। প্রকৃত মুসলমান কখনো জঙ্গীবাদ বিশ্বাসী হতে পারে না। তাদের কেউই জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, জঙ্গীবাদ নিরূৎসাহিতকরণ ও দমনের ক্ষেত্রে অতীতে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের দ্ব্যর্থহীন ভূমিকা ও অবদানের কথা বিশেষভাবে স্বীকার্য ও স্বীকৃত হয়েছে। মাদরাসায় যারা পড়ান, মাদরাসা যারা পরিচালন করেন মূলত তারাই এই ভূমিকা ও অবদানের নিয়ামক।
শুধু দ্বীনি শিক্ষাদানই নয়, মাদরাসার শিক্ষক এবং সেইসঙ্গে আলেম ও ইমামরা সামাজিক শিক্ষকও বটে। তারা প্রত্যেকেই স্বস্ব এলাকায় শ্রদ্ধেয় ও মান্যমান ব্যক্তি। সমাজের ওপর, সমাজমানসের ওপর, ব্যক্তির ওপর তাদের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব রয়েছে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন মহাসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে যথার্থই বলেছেন, আজকে ঢাকা শহরে দুই লাখের বেশী মাদরাসা শিক্ষক উপস্থিত হয়েছেন। তারা কেবল মাদরাসার শিক্ষকই নন, তাদের মধ্যে এক লাখ মসজিদের খতিব রয়েছেন। তারা ৮০ লাখ মাদরাসা শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি, ২০ হাজারেরও বেশী মাদরাসার অভিভাবক। এসব আলেম-ওলামা এক লাখ মাইন্ড, তিন লাখ মহাফিলে উপস্থিত হয়ে এখানকার এক লাখ বক্তা সমাজ গঠনে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। দেশের এসব শীর্ষ আলেম দেড় কোটি ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন। এখানে যারা উপস্থিত আছেন এর বাইরে বাংলাদেশ নেই। এখানে বাংলাদেশের যে ক্ষুদ্র চিত্র, এটাই প্রকৃত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের মন-মানসিকতা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার, চিন্তা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই আলেম সমাজ। তাঁর এ বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা আরো বলতে চাই, শিক্ষাদানই কেবল নয়, সমাজ গঠনে, সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত, মাদকমুক্ত, অনাচারমুক্ত, অপরাধ ও দুর্নীতি মুক্ত করার ক্ষেত্রে মাদরাসার শিক্ষকরা অপরিসীম অবদান রেখে যাচ্ছেন। তারা সমাজ উন্নয়ন, সমাজকে সভ্য ও সুশৃংখল করার ক্ষেত্রে স্বত:স্ফূর্তভাবে ভূমিকা না রাখলে, সংস্কারের দায়িত্বে ব্রতী না হলে সমাজ এতদিনে কী অবস্থায় পৌঁছাতো, সহজেই অনুমেয়। শিক্ষক হিসাবে তাদের দাবি-দাওয়া অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। শিক্ষক হিসাবেই সেটা পাওয়ার হকদার তারা। তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক ভূমিকা ও অবদানের বিষয়টিও সহৃদয় বিবেচনায় নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, বলার অপেক্ষা রাখেনা, মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপারে বরাবরই উৎসাহী ও সহানুভূতিশীল। মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষার প্রতি তার এই দরদী মনোভাব থেকেই তিনি এ শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে সঙ্গতকারণেই আমরা আশা করি, মাদরাসা শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া তিনি বিবেচনায় নেবেন এবং দাবিপূরণ করে লাখ লাখ সম্মানীয়, শ্রদ্ধেয় আলেমের দোয়ার ভাগীদার হবেন। তাদের উন্নত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিয়ে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে তাদের ভূমিকাকে আরো জোরদার করবেন।

২৯জানুয়ারী,২০১৮ সোমবার:ক্রাইমর্বাতা.কম/সম্পাদকীয়/আসাবি

Check Also

প্রত্যেকটা অফিসের কেরানি পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর : আসিফ মাহমুদ

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।