ক্রাইমবার্তা রিপোট: ঢাকা: এদেশের হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে আরো পরিচিত করতে, আরো সমৃদ্ধ করার জন্য বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আর অশুভ পথে ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের জন্য, নিজের ভাষার জন্য কিছু করে না, তারা নিজেদের আখের গোছাতেই সব সময় ব্যস্ত থাকে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
এছাড়া ভাষার মাসে বাংলা একাডেমি চত্বরে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (১ জানুয়ারি) বিকালে বাংলা একাডেমি চত্বরে এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরে এসব কর্মকাণ্ডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমরা বাংলা একাডেমির এই বইমেলায় উপস্থিত হয়েছি, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন কিন্তু প্রথম বঙ্গবন্ধুই শুরু করেছিলেন। আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা, আমরা যেন মাতৃভাষায় কথা বলতে পারি, তার সব ব্যবস্থা তিনি করে গিয়েছিলেন।’
অনুষ্ঠানে এ বছর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার, স্মারক ও সার্টিফিকেট তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দু’টি ভূখণ্ড, এদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১২শ কিলোমিটার। দুই ভূখণ্ডের ভাষা-সংস্কৃতি- সবকিছুই ভিন্ন। দুই ভূখণ্ডের জনসংখ্যায় আমরা বেশি ছিলাম। তারপরও আমরা শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছিলাম। তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি।’
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তারই প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসসহ অন্যান্য সংগঠন মিলে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। তারই প্রস্তাবে ১৯৪৭ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকা হয়। ওই ধর্মঘট পালন করার সময় পিকেটিং করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। সেই আন্দোলন ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হয়ে তিনি সারাদেশ সফর করেন। এই আন্দোলনের একটা পর্যায়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়, তাকে আর মুক্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু বন্দিখানায় থেকেও যখনই তিনি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন, ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কথা বলেছেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবসময় নির্দেশ দিয়েছেন। এসময় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অংশও পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কিন্তু ভাষার মর্যাদার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আমি এটুকু বলতে পারি- আজ আমাদের যা যা অর্জন, সবকিছুর পেছনে আমাদের মহান ত্যাগ যেমন রয়েছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুরও অবদান রয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলো, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলো। কিন্তু যুক্তফ্রন্টকে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। এরপর ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। সেই শাসনতন্ত্রেই কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারই ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, সরকারি ছুটি দেয় এবং সেইসঙ্গে শহীদ মিনার গড়ার প্রকল্প গ্রহণ করে। বাজেটের টাকা দিয়ে শহীদ মিনার তৈরির কাজও শুরু হয়েছিল। এরপর আবার আমাদের দেশে মার্শাল ল জারি হলো। আর মার্শাল ল জারি হলে যা হয়, আমাদের পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে গেল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরপর জাতির পিতা ছয় দফার ভিত্তিতে যে সংগ্রাম করেছিলেন, তারই পথ বেয়ে, অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা আন্দোলন, এরপর আমাদের স্বাধীনতা। আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের সবসময় একটা আঘাত আসে। মাত্র সাড়ে ৩ বছর জাতির পিতা হাতে ক্ষমতা পেয়েছিলেন। এরই মধ্যে তিনি একাট জাতিকে, একটা প্রদেশকে রাষ্ট্রে পরিণত করে, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, তার সবকিছু করেছিলেন। আজকে আমরা বাংলা একাডেমির এই বইমেলায় উপস্থিত হয়েছি, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন কিন্তু প্রথম তিনিই শুরু করেছিলেন। আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা, আমরা যেন মাতৃভাষায় কথা বলতে পারি, তার সব ব্যবস্থা তিনি করে গিয়েছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কিন্তু এরপর আবার যখন মার্শাল ল সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা আর যা হোক, বাঙালি জাতির সংস্কৃতি, বাঙালি জাতির সাহিত্য চর্চা, বাঙালি জাতির বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো— এই কাজগুলোর দিকে তাদের তেমন কোনও মনোযোগ ছিল না। আর থাকতেও পারে না। কেন পারে না? খুব স্পষ্ট। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, তারা সবসময় আতঙ্ক থাকে। এই ক্ষমতাকে কীভাবে নিষ্কণ্টক করা যায়, তা নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকে। তারা কিছু লোককে খুশি করে, একটা এলিট শ্রেণি তৈরি করে, যাদের মাধ্যমে তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চায়। কিন্তু সার্বিকভাবে একটি দেশের উন্নতি কীভাবে হবে, তার ভাষা, তার সংস্কৃতি চর্চা কীভাবে হবে, একটি দেশের জনগণ কীভাবে আর্থসামাজিক দিক থেকে এগিয়ে যাবে, সেসব দিকে তারা কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানে জিম্বাবুয়ে, মিশরসহ কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকজন লেখক-সাহিত্যিকও বক্তব্য রাখেন।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৭ দেয়া হয়।
এবার লেখক প্রকাশকদের দাবির মুখে মেলার সময়সূচি বৃদ্ধি করা হয়েছে। ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে এ মেলা। এছাড়া ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।
মাসব্যাপী এ মেলা উপলক্ষে ২২-২৩শে ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ফ্রান্স, স্পেন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ আটটি দেশের ১৫ জন কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী অংশ নেবেন। এছাড়া ২ থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকাল ৪টায় মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার।
মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে এবারও থাকছে শিশু কর্নার। এই কর্নারকে শিশু-কিশোর বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবারও ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা করা হবে। শিশু কর্নারে এবার নতুন সংযোজন ‘মাতৃদুগ্ধ সেবাকেন্দ্র’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।
মেলায় আগত মানুষের বসার স্থানসহ নান্দনিক ফুলের বাগানও নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রন্থমেলায় টিএসসি, দোয়েল চত্বর দিয়ে দুটি মূল প্রবেশপথ, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তিনটি পথ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার আটটি পথ থাকবে।
এবারই প্রথম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন নতুন সুপ্রশস্ত গেট নির্মাণ করা হয়েছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলা এলাকায় আড়াইশো ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রন্থমেলা সম্পূর্ণ ধূমপানমুক্ত থাকবে।