ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: ওয়াশিংটন: নিউইয়র্কের ব্রোক্সে বেড়ে ওঠা হিজাবি নারী নাজমা খান অল্প বয়স থেকেই ধর্মীয় বৈষম্যের সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত।
বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত নাজমা খান ১১ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। তিনি হাই স্কুল ও কলেজ জীবনে ক্রমাগতভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের মারাত্মক হামলার পর এই উৎপীড়ন নতুন আরেকটি স্তরে পৌঁছায়।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন রাস্তায় হাঁটার সময় আমাকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতো। সন্ত্রাসী, ওসামা বিন লাদেন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে আমাকে পেছন থেকে ধাওয়া করা হতো, শরীরের ওপর থুতু ফেলত, পুরুষেরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরত।’
হিজাবের কারণে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া অন্যান্য মুসলিম নারীদেরকে একত্রিত করতে নাজমা খান তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের অভিজ্ঞতা সামাজিক মিডিয়ায় শেয়ার করার আহ্বান জানান।
৩৫ বছর বয়সী নাজমা খান বলেন, ‘তাদের শেয়ার করা গল্পগুলো পড়ার সময় নিজের সংগ্রামের দৃশ্য আমি আমার বোনদের মধ্যে দেখতে পাই।’
এসব ঘটনা তাকে খুব বেশি আহত করে। এরপর তিনি ‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ চালু করার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে নাজমা খানের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ডাব্লুউএইচডি’ বিশ্বব্যাপী মুসলিম নারীদের সঙ্গে সংহতির একদিনের জন্য হিজাব পরিধান করার জন্য সকল ধর্ম, বর্ণ, পটভূমি এবং জাতি গোষ্ঠীর নারীদেরকে আমন্ত্রণ জানায়।
‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ এর আয়োজক সংগঠনের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘১ ফেব্রুয়ারি তারিখে একদিনের জন্য আমার সঙ্গে তালমিলিয়ে হাঁটতে থাকা নারীরা দেখতে পাবেন যে আমি তাদের থেকে আলাদা নই।’
তিনি বলেন, ‘এই একদিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সম্ভবত তারা হিজাবের আলাদা আলো দেখতে পাবেন।’
গৎবাধাঁ ধারণার পরিবর্তন
২০১৩ সালে ‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ শুরু হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত ৪৫টিরও বেশি দেশের ৭০ জন রাষ্ট্রদূত এতে জড়িত হয়েছেন এবং প্রায় ১৯০টি দেশের নারীরা বার্ষিক এই ইভেন্টে অংশ নেয়।
এদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ খ্রিস্টান নারী এলি লয়েড ও তার ১১ বছর বয়সী মেয়েও। এলি লয়েড বর্তমানে কাতারে ডাব্লুউএইচডি’র একজন দূতের দায়িত্ব পালন করছেন।
এলি লয়েড বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি নারীদের মাথায় হিজাব পরিধানের পছন্দের বিষয়টি সব ধরনের পক্ষপাতিত্ব এবং বৈষম্য মুক্ত হওয়া উচিত।’
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি যদি মাথায় টুপি পরতে পছন্দ করি, সেই ক্ষেত্রে আমাকে বিচার করা হয় না। আমি যদি আমার চুলকে উপর বা নিচে কিংবা ছোট করে রাখি, তখন আমাকে কিছু মনে করা হয় না।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন,‘কিন্তু একজন নারী যখন হিজাব পরতে পছন্দ করেন, তখন কেন তাকে নানাভাবে বিচার করা হবে?’
আমেরিকান-ইসলামিক কাউন্সিলের নিউইয়র্ক চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক আফাফ নাসের মনে করেন বাৎসরিক এ্ই দিবসটি উৎযাপনের মাধ্যমে ধর্মীয় হিজাব সম্পর্কে যে গৎবাধাঁ মিথ্যা ধারণা রয়েছে তা ভেঙে দিতে সহায়তা করবে।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানকে দৃষ্টিকটুভাবে বিদেশি, বাধ্যগত এবং সেকেলে হিসেবে দেখা হয়।’
ইসলাম বিদ্বেষ
যুক্তরাজ্যে কর্মরত চেক বংশোদ্ভূত মিরোস্লাভাকে হিজাব পরিধানের জন্য তাকে ‘দুশ্চরিত্রা’, ‘আইএস’ উপাধি দিয়ে তাকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়। চার বছর আগে হিজাব পরা শুরু করার পর থেকে তাকে বিভিন্নভাবে অবমাননাকর শ্লীলতাহানির শিকার হতে হয়েছে।
৩৫ বছর বয়সী মিরোস্লাভা আল জাজিরা বলেন, ‘রাস্তায় হাঁটার সময় প্রায়ই আমাকে মজারসব প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়। যেমন: ‘এতে আপনার গরম অনুভুত হয় না?’
তিনি বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহের জন্য আমি একটি নতুন জায়গায় গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে এসে দেখতে পাই আমার জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর একটি চিঠি নিক্ষেপ করা হয়েছে। এতে লেখা রয়েছে, ‘এটা তোমার দেশ নয়!’’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়া ও ঘৃণা অপরাধের ঘটনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
লস এঞ্জেলেসের বাসিন্দা ওজাল আহমদ বলেন, ‘হিজাব নারীদেরকে স্পষ্টভাবে মুসলিম হিসেবে দৃশ্যমান করে এবং এ কারণে তারা ইসলামফোবিয়ার একটি সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পর ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিরোধী ঘৃণা অপরাধ ৯১ শতাংশ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
‘স্ট্রং ইন হিজাব’
বিভিন্ন চ্যালেজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও নাজমা খান আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে সামাজিক মাধ্যম মুসলিম নারীদেরকে তাদের অসন্তুষ প্রকাশ করার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে।
বিশ্ব হিজাব দিবস উৎযাপনের মাধ্যমে অলাভজনক এই সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিজাব সম্পর্কে মানুষকে বুঝানো, সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষিত করার বিষয়ে সেতুবন্ধন তৈরি করতে চান।
‘ডাব্লুউএইচডি’র প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘আমার মাথা ঢেকে রাখার জন্য হিজাব কেবল এক টুকরো কাপড় নয়। এটি এর চেয়েও বেশি কিছু। হিজাব মানুষ হিসেবে আমার ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে।’
১ ফেব্রুয়ারি তারিখে দিন উৎযাপনের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাসট্যাগ দিয়ে বিশ্বজুড়ে নারীরা তাদের হিজাব পরিধানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে থাকেন।
এবছরের স্লোগান হচ্ছে- #StrongInHijab.
ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
আল জাজিরা অবলম্বনে