৮ ফেব্রুয়ারির প্রভাব প্রশাসনেও : কিছুই হবে না, বরং বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রশাসন আরও প্রো-আওয়ামী লীগ হবে -বদিউর রহমান * নাগরিক হিসেবে প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক, তবে আমলাদের অ্যাকটিভ রোল থাকা কাম্য নয় -আবু আলম শহিদ খান
—0–
ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। এদিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যদি সাজা হয় তাহলে কী হবে? নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভর করা এমন আলোচনা থেকে প্রশাসনপাড়াও বাদ যাচ্ছে না। আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ বলছেন, কিছুই হবে না। বিএনপি তো রাজপথেই দাঁড়াতে পারবে না। বরং এ যাত্রায় রাজপথের আন্দোলনে দলটির ব্যর্থ হওয়ার স্বরূপ আবারও স্পষ্ট হবে। ফলে প্রশাসন প্রো-আওয়ামী লীগ হিসেবে জোরেশোরে বিকশিত হবে।
‘কিছু একটা ঘটতে পারে’ কেউ আবার এমন শঙ্কায় পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পক্ষে। তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, যা কিছু হোক না কেন এ রায়ের মধ্য দিয়ে বড় দুটি দলের মধ্যে নিশ্চিতভাবে ক্ষমতার রাজনীতির ফাইনাল খেলা শুরু হয়ে যাবে। তবে খেলায় ড্র হওয়ার সুযোগ থাকলেও এখানে তেমনটি হবে না। কেউ হারবে, কেউ জিতবে।
বিদ্যমান প্রেক্ষাপট সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে এমন উত্তরই মিলবে। আর আমলারা তাদের চিরায়ত চরিত্র থেকে কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবেন না। মাঠ দখলের রাজনীতি যে দলের পক্ষে থাকবে, প্রশাসনের ক্রীড়নকরা সেদিকেই পাল তুলবেন। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে এমন চিত্রই দেখা গেছে। তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের নামে পর্দার আড়ালে আসলে বাতাস বুঝে খোলস পাল্টানোর প্রস্তুতি চলছে।
প্রশাসনবিষয়ক কলামিস্ট ও সাবেক সচিব বদিউর রহমান বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি কিছুই হবে না। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যা দেখা যাচ্ছে তাতে খালেদা জিয়ার সাজা হলেও বিএনপি কিছুই করতে পারবে না। কারণ তারা রাজপথে দাঁড়াতে পারবে না। কিংবা দাঁড়াতে দেবে না। যদি অলিগলি থেকে ছিঁটেফোটা কিছু হয়ও তাতে প্রশাসনে বিএনপির পক্ষে কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং এ ইস্যুতে বিএনপি মাঠে ফেল করলে প্রশাসন আরও প্রো-আওয়ামী লীগ হবে। প্রশাসনের মধ্যে যারা বিএনপিমনা তারা টুঁ শব্দটি করবেন না।’ তিনি বলেন, ‘আর এটা তো চিরন্তন সত্য যে, প্রশাসন কারও নয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তা সুযোগসন্ধানী। রাজনীতির মাঠের নিয়ন্ত্রণ যেদিকে গড়াবে কর্মকর্তারাও সেদিকে থাকবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে টানা ৯ বছর। তাই নতুন করে এখন আর কাউকে আওয়ামী লীগার বানানোর দরকার নেই। যেমন ধরুন, নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন যদি তার মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তিন দফায়ও রদবদল করে তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ বহু ধাপে এখন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা বসে আছেন।
কেউ অস্বীকার করলেও এটিই বাস্তবতা।’ বদিউর রহমান বলেন, ‘বিশেষ করে যারা দুর্নীতি করেছেন কিংবা দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন তারা তো জানবাজি রেখে এ সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার সব চেষ্টা করবেন। এটি তারা নিজেদের স্বার্থেই করবেন।’
প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান মঙ্গলবার বলেন, ‘প্রশাসনে যারা চাকরি করেন তারা তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। তাই দেশের যে কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের নাড়া দেবে। তারা চিন্তাভাবনা করবেন, তাদের চিন্তাভাবনার জগতে প্রভাব বিস্তার করবে। কী হবে, না হবে এ ধরনের শঙ্কা ও উদ্বেগ কাজ করবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের অ্যাকটিভ রোল কিংবা ইনভলভমেন্ট থাকার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটা সম্পূর্ণ জুডিশিয়াল বিষয়, প্রশাসনিক নয়।’
তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে প্রশাসনে বড় পরিবর্তন হয়েছে। যারা প্রশাসনে কাজ করছেন তারা নিজেদের নিরপেক্ষ ভাবছেন না। নিরপেক্ষ ভাবার সুযোগও কমে যাচ্ছে। কারণ তারা দেখছেন দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও পোস্টিং হচ্ছে। তাই তারা মনে করছেন, যেদিকে বাতাস সেদিকে থাকাই ভালো। আমলাদের মধ্যে এ ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এটা প্রত্যাশিত নয় এবং রাষ্ট্রের জন্য সুখকর হবে না।’
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকদিন থেকে নানা আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও প্রশাসনের স্টিয়ারিং সিটে এখন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের একক নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে। তারা ব্যক্তিস্বার্থে কিছুটা দ্বিধা-বিভক্ত থাকলেও পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে অটল। তাই যে যার অবস্থান থেকে বিএনপি ঠেকাও ভূমিকায় খুবই সক্রিয়। এ অবস্থায় ৮ তারিখের রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তারা খুব একটা বিচলিত নন। এ সারির কয়েকজন কর্মকর্তা সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির কোনো নেতাকর্মী-সমর্থক কোথাও প্রতিবাদ নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনগণও ঐক্যবদ্ধ।
এদিকে চিহ্নিত বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা ছাড়াও যারা আওয়ামী লীগ সেজে প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছেন, তারা অবশ্য ভেতরে ভেতরে নানা আশায় বুক বেঁধেছেন। তাদের মতে, বিএনপিকে সরকার ও সরকারি দল এখন এমন স্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যে, সামনে দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। ফলে রাজপথে কার্যকর প্রতিবাদ না করার কোনো বিকল্প নেই। এ সারির কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল যুগান্তরকে বলেন, তাই এটি নিঃসন্দেহে রাজনীতির মাঠে ফাইনাল খেলা। এ খেলায় জয় অথবা পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু নেই।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার দিন থেকে এ খেলার ক্ষণ গণনা শুরু হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, রাজনীতিতে সব সময় একই স্টাইলে আন্দোলন-সংগ্রাম হয় না। মানুষ যখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকার হারিয়ে ফেলে তখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। পৃথিবীতে এর বহু নজির আছে। তারা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো কারণে সাধারণ মানুষ একবার রাজপথে নেমে এলে সেখান থেকে তাদের আর ফেরানো সম্ভব হবে না।
সে রকম কোনো পরিস্থিতি সামনে এলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি দল সমর্থক হিসেবে পরিচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা সোমবার বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট দিয়েছে, বিএনপি আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের হামলা করার ফর্মুলা নিয়ে এগোচ্ছে। পরিকল্পনাটি কোথায়, কারা করেছেন সব তথ্য আমরা জেনেছি।
কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব ধরনের অপরাধ দমনে আগের থেকে অনেক বেশি সক্ষম। কোনোভাবেই কাউকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে দেয়া হবে না। সবকিছু শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে।যুগান্তর