ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সতর্কতা অবলম্বন করছে। ক্ষমতাসীন দলটির নেতাদের ‘স্ববিরোধী কথাবার্তায়’ অস্থিরতা লক্ষণীয়। প্রথমে রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপির সাংগঠনিক প্রস্তুতি দেখে পাল্টা মাঠ দখলের ঘোষণা দিলেও সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়রের ‘মাঠ দখলের ঘোষণা’ এবং অন্য নেতারা হুঙ্কার; পরবর্তীতে যুবলীগের প্রস্তুতি সভায় ওবায়দুল কাদের ‘রাস্তায় না নামার’ ঘোষণা দেন। ভেতরে ভেতরে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলেও নেতাকর্মীদের শুধু সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু গতকাল আবার ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি না দিলেও ওই দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সহায়তা করবে।
বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শে রায়ের দিন উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়া হলেও সারাদেশে ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে। মূলত দিনটিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় কঠোর প্রস্তুতি নিয়েছে। ইতোমধ্যেই পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নাশকতার আশঙ্কায় সারাদেশে পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের কাছে ‘সতর্ক করে’ বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও বিএনপি যেন সভা-সমাবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর হতে বলা হয়েছে। মামলার রায়ের দিন ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে কোনো ধরনের মিছিল করা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সব ধরনের ছড়ি বা লাঠি, ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকার প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করছে। বিএনপি নেতাদের কোথাও দাঁড়াতে না দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের অনুগত ১৫ হাজার পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বাসস্ট্যান্ডে লাঠি হাতে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সবার দৃষ্টি এখন ৮ ফেব্রæয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের দিকে। রাজনৈতিক বিচ্ছৃঙ্খলার শঙ্কায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ারবাজার নি¤œমুখী হয়েছে। কি হয় সে আশঙ্কায় ক্ষুদ্র ও নি¤œ আয়ের মানুষ উৎকণ্ঠিত। ওই দিন কি রায় হয় সেটা জানার জন্য দেশের কোটি কোটি মানুষ তো বটেই; ঢাকায় কর্মরত বিদেশী রাষ্ট্রদূত, দাতা দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখিয়ে আছেন। বিএনপি ইতোমধ্যেই অভিযোগ করেছে নি¤œ আদালত সরকারের ওপর মহলের নির্দেশে চলে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বেগম জিয়াকে ওই মামলায় আসামি করে দ্রæত মামলার রায় দেয়া হচ্ছে। নেতিবাচক রায় এলে প্রতিবাদ করার প্রস্তুতি নেয় দলটি। একই সঙ্গে কোনো প্রকার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করা হবে না এমন ঘোষণাও দেয়া হয়। এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বিএনপির একাধিক নেতা খালেদা জিয়ার সাজা হলে স্বেচ্ছা কারাবরণসহ নানা কর্মসূচির প্রস্তাব দেন। তারা বলেন, বেগম জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার নীলনকশায় মামলার রায় দেয়া হচ্ছে। নেত্রীকে যদি জেলে নেয় এবং পুলিশ যদি আমাদের গ্রেফতার না করে, তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমেই মুক্ত করা হবে খালেদা জিয়াকে। এ সময় উপস্থিত নেতারা ¯েøাগান দেন, ‘নেত্রী মোদের মা/জেলে যেতে দেবো না’। বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমি যেখানেই থাকি আপনাদের সঙ্গেই রয়েছি। আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে থাকবেন।’ বেগম জিয়া এরই মধ্যে সিলেট সফরে গিয়ে হজরত শাহজালাল (রহ:) ও শাহপরাণ (রহ:)-এর মাজার জিয়ারত করে এসেছেন। তার সিলেট যাওয়ার ৫ দিন আগ (৩০ জানুয়ারি) থেকে বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার অভিযানে নেমেছে পুলিশ। কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ ইতোমধ্যেই ১২শ’ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে রায়কে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য বিচ্ছৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর তৎপর হতে দেখা যাচ্ছে। সূত্রের দাবি, বেগম জিয়ার মামলার রায়কে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছে পুলিশ প্রশাসন। রায়ে যদি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হয় ফুঁসে উঠবে দেশের মানুষ। ওই দিন বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শরিকরা রাজপথে নেমে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে পারে; এমন আশঙ্কা থেকেই বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এ জন্যই আগাম প্রস্তুতি, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সার্বিক পরিস্থিতি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গতিবিধির ওপর নজরদারির পাশাপাশি জেলা, মহানগর ও বিভাগীয় শহরগুলোর নেতাকর্মীরা কী করছেন তা তদারকির কথা বলা হয়েছে।
জানা যায়, রায়ের আগের রাত থেকে পুরান ঢাকার আদালত এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর সব থানা এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে। সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় বিশেষ সতর্কতা নেয়া হবে। উল্লেখ্য, ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়াসহ দুই দলের অনেক সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও বেগম জিয়াসহ বিএনপির নেতাদের মামলাগুলো অব্যাহত রাখা হয়। ৮ ফেব্রæয়ারি যে মামলার রায় ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে এত অস্থিরতা সেটা দায়ের করা হয় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই।
৮ ফেব্রæয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে একদিকে দেশজুড়ে আতঙ্ক; অপরদিকে রয়েছে উত্তেজনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির অভিযোগ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে এ পর্যন্ত ১২শ’ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার রায় এবং গ্রেফতার নিয়ে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এরই মধ্যে তৃণমূল থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই দিন রায়ে খালেদা জিয়া নির্দোষ প্রমাণিত হলে বিএনপির নেতাকর্মীরা উল্লাস করবেন। কিন্তু সাজা হলে নেতাকর্মীরা অবশ্যই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। এ ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা বিঘিœত হওয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। সেই আশঙ্কা থেকেই পুলিশ প্রশাসন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। তবে রায়কে ইস্যু করে কোনো ধরনের সহিংস কর্মসূচি না নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সিলেটে মাজার জিয়ারত করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ঘরোয়া বৈঠকে দলীয় নেতাদের বলেছেন, সহিংস কর্মসূচিতে আপাতত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে আপনারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।
৮ ফেব্রæয়ারি রায় কি হবে তা কেউ জানেন না। রায়ের তারিখ পিছিয়ে যাবে কি না সেটাও অজানা। তারপরও ওই রায়কে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে উত্তেজনা; দেশব্যাপী অস্থিরতা, শেয়ারবাজারে ধস; তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বেগম জিয়া আমাদের শত্রæ নয়; কিন্তু বিএনপি আমাদের শত্রæ ভাবে। আদালত স্বাধীনভাবে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই মামলার রায় কী হবে তার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে কখনও চাইব না কোনো রকম নৈরাজ্য সৃষ্টি হোক। তারা (বিএনপি) যদি উস্কানি দেয়, হাইকোর্টের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাহলে আমরাও চুপ থাকব না। কোনো পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি না দিলেও জননিরাপত্তায় বিঘœ ঘটলে পুলিশকে সহযোগিতায় রাস্তায় নামবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেছেন, খালেদা জিয়া ৮ ফেব্রæয়ারি খালাসও পেতে পারেন; আগে থেকেই সাজা হবে ধরে নেয়া বাস্তবসম্মত নয়। রায়কে কেন্দ্র করে রাজপথে আওয়ামী লীগ নামবে না। তবে কেউ বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে। আদালতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঠিক নয়। রায় কি হবে কেউ জানে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গতকালও বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হয়নি, মামলা হয়েছে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়। আমরা বলেছি এই মামলায় আদালতে বেগম জিয়া যদি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমরা খুশি। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এই মামলা নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বিএনপি। রায়কে সামনে নিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা জনগণ তা মেনে নেবে না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকার রায় নির্ধারণ করে রেখেছে বলেই প্রতিক্রিয়ার অজানা আতঙ্কে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে। দেশে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনকে আটকিয়ে রাখতেই পুলিশকে ক্ষমতাবান করা হয়েছে। আর পুলিশ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সরকারের নিষ্ঠুর শাসনের সঙ্গী হিসেবে অমানবিক নিপীড়নযন্ত্রে পরিণত হয়েছে।ইনকিলাব
Check Also
৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …