ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতি যারা করবে, সন্ত্রাস যারা করবে, জঙ্গিবাদে যারা জড়াবে, তাদের বিচার হতেই হবে। কারণ আমরা দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আনতে চাই। আমরা দেশকে উন্নত করতে চাই। জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চাই। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও স্বজনপ্রীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অপসারণ করতে পারব।
রোমের পার্কো দ্য প্রিনসিপি গ্রান্ড হোটেল অ্যান্ড এসপিএতে আওয়ামী লীগের ইতালি শাখা আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার রাতে (বাংলাদেশে বুধবার ভোর) প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন বলেই আজ তিনি কারাগারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে যে মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়েছে সে মামলা কে দিয়েছে? খালেদা জিয়ার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ফখরুদ্দীন, মইন উদ্দিন, ইয়াজউদ্দিন- এ তিনজনই তো তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দিল। এ মামলা তো আওয়ামী লীগ দেয়নি।’ তিনি বলেন, ২০০৭ সালে এই মামলা হয় এবং পরের বছরই এর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এ মামলা ১০ বছর ধরে চলে এবং শুনানির জন্য ২৩৬ কার্যদিবস ধার্য হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া আদালতে গেছেন মাত্র ৪০ দিন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, খালেদা জিয়ার আপত্তির কারণে এই মামলায় তিনবার আদালত পরিবর্তন করা হয় এবং তিনি এর বিরুদ্ধে ২৪টি রিট করেন। এভাবে মামলাকে দীর্ঘায়িত করার পরও যখন আদালত খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিল তখন বিএনপি এই ‘স্বল্প’ পরিমাণ টাকার জন্য খালেদা জিয়াকে শাস্তি দেয়ার যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে টাকা খালেদা জিয়া ও সংশ্লিষ্টরা অপব্যবহার করেছেন, সে টাকা এতিমদের জন্য এসেছিল। কিন্তু তা তাদের নিজেদের তহবিলে চলে যায়। বিএনপি নেতারা বলেন, সেই টাকা তাদের তহবিলে রাখার ফলে দুই কোটি থেকে বেড়ে তিন কোটি হয়েছে। কিন্তু এতিমরা এ থেকে কি লাভটা পেল।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি খালেদা জিয়া বলতেন, সেই টাকা তিনি তার এতিম দুই পুত্রের জন্য রেখেছেন, তারও না হয় একটি যৌক্তিকতা ছিল।’
শেখ হাসিনা বলেন, যখন মামলাটি করা হয় (ব্যারিস্টার) রফিকুল হক সে সময় বলেছিলেন, খালেদা জিয়া ওই পরিমাণ টাকা জমা করে দিলেই মামলাটি প্রত্যাহার হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি (খালেদা জিয়া) টাকার মায়া ছাড়তে পারেননি। তখন টাকার যে মূল্য ছিল তা থেকে দুই কোটি টাকা দিয়ে তিনি চারটি ফ্ল্যাট কিনতে পারতেন, এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। টাকার মায়া ত্যাগ করতে পারেননি বলেই আজকে তিনি কারাগারে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে যারা বিএনপি দরদি, আঁতেলরা আছে, তারা বলে- দুই কোটি টাকার জন্য কেন এই মামলা। তাহলে আমার এখানে একটা প্রশ্ন আছে, দুর্নীতির করার জন্য কি একটা সিলিং থাকবে যে এত কোটি পর্যন্ত দুর্নীতি করা জায়েজ। তারা কি সেটা বলতে চায়?’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি তাহলে একটা দাবি করুক যে এত কোটি পর্যন্ত তারা দুর্নীতি করতে পারবে। সেটা নিয়ে একটা রিট করুক।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, যে মামলা ১০ বছর ধরে চলেছে। এখানে আমাদের তো করার কিছু নেই। আর আমরা যদি করতামই তাহলে ১০ বছর তো চলতে দিতাম না। ২০০৮-এ যখন ক্ষমতায় এলাম, তখনই তো শেষ করতে পারতাম।’
রায় বাতিলের জন্য বিএনপির চলমান আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মেরেছে। বিএনপির অভ্যাস আছে টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে নেয়ার কিংবা বিচারকদের দরজায় লাথি মারার এবং মাস্তানি করার, আমরা সেটা জানি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দুই ছেলে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। যাদের টাকা আমরা ফেরত এনেছিলাম। তারেকের বিরুদ্ধে এফবিআই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।’ বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৫ সালে নির্বাচন প্রতিরোধ ও সরকার পতনের নামে এই বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগ করে। ২০১৩ সালে তারা (বিএনপি-জামায়াত জোট) আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। তিন হাজারের ওপর মানুষকে তারা আগুন দিয়ে ঝলসে দিয়েছে। ওই তিন বছরে প্রায় ৫শ’ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। পুলিশ, বিজিবি, সেনা সদস্যকে পুড়িয়ে মেরেছে।’ তিনি আরও বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান, শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) প্রধানমন্ত্রী হয়ে কালো টাকা সাদা করেছেন। কোথা থেকে এলো এই টাকা? তার সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পরপর ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।’
এ সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি প্রত্যেকটি মামলার তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিলাম। মামলাগুলোর প্রকৃত অবস্থা আমরা যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলাম। প্রত্যেকটি মামলার তদন্ত হয়েছে এবং এর রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। আমি কোনো মামলা প্রত্যাহার করিনি এবং এর অনুমতিও দেইনি, কেন আমি এটা করব। আমি জানতাম, আমি তো কোনো দুর্নীতি করিনি।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হিলারি ক্লিনটন সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে সময় তাকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দোষ ধরতে মুখিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ওই সময় তিন-তিনবার আমার ছেলেকে এ ব্যাপারে হুমকিও দেয়। এটি কানাডার আদালতেই প্রমাণ হয়েছে যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বলেছিলাম আমি দুর্নীতি করার জন্য ক্ষমতায় আসিনি। আমি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই ক্ষমতায় এসেছি। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নয়।’
দেশের বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দুর্নীতির প্রমাণ হয়েছে আদালতে। আদালত যখন দেখেছে বিএনপি নেত্রীর মাধ্যমে এতিমের টাকার সম্পূর্ণ অপব্যবহার হয়েছে তখন আদালত তাকে এই শাস্তির রায় দেয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এক্ষেত্রে আমাকে তিরস্কার এবং সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কি যুুক্তি থাকতে পারে?’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রবাসীদের কল্যাণে তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি সরকারের দুর্নীতি এবং তাদের ভুল সিদ্ধান্ত বিমানকে ধ্বংস করে দিয়েছে (বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স)। লাভজনক হলে আমরা পুনরায় ঢাকা-রোম ফ্লাইট চালু করব।’
ইতালি শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ফরাজির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন হাসান ইকবাল। মঞ্চে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল দাশ গুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক এমএ গনি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ। বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীর ফরাজি, এমএ রব মিন্টুু, বেগম হোসনে আরাসহ ইতালি আওয়ামী লীগের নেতারা।
অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন- জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতি বশিরুল আলম চৌধুরী সাবু, ফ্রান্স আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ সেলিম, ডেনমার্ক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ড. বিদ্যুৎ বড়–য়া, সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি তাজুল ইসলাম, বেলজিয়াম আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল হক, হল্যান্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন তপন, সুইডেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ড. ফরহাদ আলী খান, স্পেন আওয়ামী লীগ সভাপতি আখতার হোসেন আতা, ফিনল্যান্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল ইসলাম প্রমুখ।
কাল দেশে ফিরছেন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতালি ও ভেটিকান সিটিতে তার ৪ দিনের সরকারি সফর শেষে বুধবার রাতে দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের একটি বিমান স্থানীয় সময় রাত ১০টায় (বাংলাদেশে রাত ৩টা) রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফিউমিসিনো বিমানবন্দর থেকে আবুধাবির উদ্দেশে যাত্রা করে। আজ সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে যাত্রাবিরতি করবেন তিনি। কাল সকাল ৮টায় তাকে বহনকারী বিমান ঢাকায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছবে।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) ৪১তম পরিচালনা পর্ষদের অধিবেশনে যোগ দিতে রোববার রোম পৌঁছেন। তিনি পোপ ফ্রান্সিসের আমন্ত্রণে পোপের সঙ্গে বৈঠক করতে হলি সি (ভেটিকান সিটি) সফর করেন।