সূরা সিজদাহ; আয়াত ২৬-৩০
কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা সিজদাহর ২৬ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَوَلَمْ يَهْدِ لَهُمْ كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِمْ مِنَ الْقُرُونِ يَمْشُونَ فِي مَسَاكِنِهِمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ أَفَلَا يَسْمَعُونَ (26)
“এতে কি তাদের চোখ খোলেনি যে, আমি তাদের পূর্বে অনেক (জাতি ও) সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি, যাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘরে এরা যাতায়াত করে? অবশ্যই এতে (শিক্ষণীয় বিষয় ও) নিদর্শনাবলী রয়েছে। তারা কি শোনে না?”(৩২:২৬)
গত আসরে মহান আল্লাহ এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি জালিমদের কাছ থেকে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আর এই আয়াতে তিনি তাদেরকে উদ্দেশ করে বলছেন: তোমরা জানো যে, তোমাদের পূর্বের অনেক অপরাধী জাতিকে আমি ধ্বংস করেছি এবং তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর-বাড়ি দেখার জন্য তোমরা সেখানে যাতায়াতও করো। এটা কি তোমাদের সৎপথে আসার জন্য যথেষ্ট নয়? ইসলাম আবির্ভাবের যুগে মক্কা থেকে সিরিয়ায় যাওয়ার পথে আদ ও সামুদ জাতির ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ি দেখা যেত। বর্তমানে এই জনপদ জর্দানে রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে সিরিয়ায় যাতায়াতকারী মক্কাবাসী অহরহ এই জনপদ দেখতে পেত। পাহাড়ের পাথর কেটে কেটে আদ ও সামুদ জাতি নিজেদের জন্য আবাসস্থল তৈরি করেছিল। একদিন এই জনপদে শক্তিশালী ও সম্পদশালী জনগোষ্ঠী বসবাস করলেও নিজেদের পাপ, জুলুম ও অন্যায়ের কারণে তারা আসমানি গজবের সম্মুখীন হয় এবং তাদের সভ্যতা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়।
এই ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতা যেন চিৎকার দিয়ে বলতে চায়, তোমরা আমাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নাও। কিন্তু সে আর্তনাদ থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো কান যেন আর অবশিষ্ট নেই।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. অতীত সভ্যতাগুলোর থেকে যাওয়া নিদর্শন সেসব জাতির পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার স্থান। এসব নিদর্শন পরিদর্শনের সময় আমরা শুধুমাত্র ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত না হয়ে যেন এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করি।
২. অতীত হচ্ছে ভবিষ্যতে চলার পথের আলোকবর্তিকা। শর্ত হচ্ছে, মানুষকে চোখ-কান খোলা রেখে অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস অধ্যয়ন করে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
৩. যদি কানকে অভ্যস্ত করানো যায় তাহলে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরিত্যক্ত জিনিসের ভেতর থেকেও প্রয়োজনীয় কথাটি শুনতে পায়।
৪. অতীত জাতিগুলোর ঐতিহাসিক নিদর্শন ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষা গ্রহণের জন্য সংরক্ষণ করা জরুরি।
এই সূরার ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন:
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا نَسُوقُ الْمَاءَ إِلَى الْأَرْضِ الْجُرُزِ فَنُخْرِجُ بِهِ زَرْعًا تَأْكُلُ مِنْهُ أَنْعَامُهُمْ وَأَنْفُسُهُمْ أَفَلَا يُبْصِرُونَ (27)
“তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি শস্যবিহীন ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে শস্য উদগত করি, যা থেকে তারা ও তাদের জন্তুরা ভক্ষণ করে? তারপরও কি তারা দেখে না?” (৩২:২৭)
আগের আয়াতে অপরাধী জাতিগুলোর ভয়াবহ পরিণতির কথা বর্ণনা করার পর এই আয়াতে মানুষসহ সকল সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়া ও রহমত বর্ষণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: তোমরা কি দেখো না মহান আল্লাহ শুস্ক ও শষ্যবিহীন ভূমিতে কিভাবে বৃষ্টির পানি পাঠিয়ে দিয়ে সেসব ভূমিকে আবাদযোগ্য করে দেন যাতে সেখান থেকে তোমরা খাদ্য আহরণ করতে পারো?
আমাদের এই পৃথিবীর পৃষ্ঠ সমতল নয়। কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু, কোথাও পাহাড়, কোথাও টিলা আবার কোথাও খাড়া উপত্যকা। এ কারণে সাগর ও মহাসাগর থেকে নদী বা খালের মাধ্যমে এই ভূমির উপর দিয়ে সবখানে পানি পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া, বেশিরভাগ সাগর-মহাসাগরের পানি লবণাক্ত যা পান করা কিংবা চাষাবাদের কাজে লাগানোর উপযোগী নয়।
অসীম প্রজ্ঞা ও ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তায়ালা সাগরের পানি বাস্পের মাধ্যমে মেঘে পরিণত করে এই দুই সমস্যারই সমাধান করে দিয়েছেন। সাগরের পানি বাষ্পের মাধ্যমে মেঘে পরিণত হয়ে বাতাসের সাহায্যে স্থলভাগে চলে আসে। এই মেঘ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে শুষ্ক ভূমি আবাদযোগ্য হয়ে যায়। এ ছাড়া, বাষ্পীভবনের সময় সাগরের লবণ সাগরেই থেকে যায় আর আকাশে উঠে যায় শুধুমাত্র মিষ্টি পানি। ফলে বৃষ্টির মাধ্যমে মানুষও পান করার উপযোগী পানি পেয়ে যায়। এটি আল্লাহ তায়ালার এক বিশাল নেয়ামত বা অনুগ্রহ যা প্রতিটি মানুষ প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু এর পেছনের গুঢ় রহস্য এবং আল্লাহর এই দয়ার কথা বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করে না। অথচ পৃথিবীকে আবাসযোগ্য করে রাখার এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য পানির এই চক্র প্রধান ভূমিকা পালন করে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. সবুজ প্রকৃতি এবং মানুষ ও পশুপাখির বিচরণস্থল আল্লাহকে চেনার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাতে পারলেই এখান থেকে তাঁকে চেনা সম্ভব হবে।
২. সাগর-মহাসাগর থেকে শত শত মাইল দূরের শুষ্ক ভূমিতে বৃষ্টিপাত দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। মহান আল্লাহর প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বৃষ্টি বর্ষিত হয়।
৩. বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে লতাগুল্ম, উদ্ভিদ ও শষ্যের বেড়ে ওঠার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর তায়ালার নিদর্শন। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিত।
সূরা সিজদাহ’র ২৮, ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْفَتْحُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (28) قُلْ يَوْمَ الْفَتْحِ لَا يَنْفَعُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِيمَانُهُمْ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ (29) فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَانْتَظِرْ إِنَّهُمْ مُنْتَظِرُونَ (30)
“এবং তারা বলে, তোমরা সত্যবাদী হলে বলো; কবে হবে (তোমার প্রতিশ্রুত) এই ফয়সালা?” (৩২:২৮)
“বলুন, ফয়সালার দিনে কাফেরদের ঈমান (আনয়ন) তাদের কোন কাজে আসবে না এবং (সেদিন) তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না।” (৩২:২৯)
“অতএব আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন এবং অপেক্ষা করুন, তারাও অপেক্ষা করছে।” (৩২:৩০)
সূরা সিজদার এই শেষ তিনটি আয়াতে আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছে: কাফের ও মুশরিকরা বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে প্রায়ই এমন একটি দিনের কথা শুনত যেদিন বাতিলের উপর হক বা মিথ্যার উপর সত্য বিজয়ী হবে। মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একথা শুনে মক্কার কাফির ও মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল ও ঈমানদারদের উপহাস করে জিজ্ঞাসা করত: এই যে তোমরা বলো আল্লাহ অপরাধীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেবেন এবং নির্দিষ্ট সময় দেয়ার পর তাদেরকে ধ্বংস করবেন- সে দিনটি কবে আসবে? কাফিরদের এই ঠাট্টাপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ বলছেন: সেদিন অবশ্যই আসবে। তোমরা ভেবনা যে, সেদিন ঈমান আনলেই তোমরা পার পেয়ে যাবে এবং সেদিন তোমাদেরকে ঈমান আনার সুযোগ দেয়া হবে। না, সেদিন আর দুনিয়াতে ফিরে যাওয়ার এবং অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ তোমরা পাবে না। শেষ আয়াতে বলা হচ্ছে: যারা সত্য উপলব্ধি করার পরও তাকে উপহাস করে, তাদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। তাদেরকে বলুন: তোমরা অপেক্ষা করো সেদিনের জন্য যেদিন আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. মানুষ সব সময় জানার জন্য প্রশ্ন করে না বরং অনেক সময় উপহাস ও ঠাট্টা করার জন্যও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।
২. ভয়াবহ বিপদ দেখে আনা ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সে সময় মানুষের কাছ থেকে ভালো ও মন্দ কাজ করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়।
৩. ওয়াজ-নসিহত ও হিতোপদেশে কাজ না হলে বিপথগামী লোকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।