মসিয়াররহমান কাজল,বেনাপোল:ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে কেবলমাত্র ভাষার টানে দুই বাংলার মানুষ একই মঞ্চে গাইলেন বাংলার জয়গান। নেতারা হাতে হাত রেখে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন বাংলাকে। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে বুধবার এভাবেই কাটালেন দুই বাংলার ‘বাংলা ভাষাভাষী’ মানুষ। একই আকাশ একই বাতাস, দু‘বাংলার মানুষের ভাষা এক। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে। তাই তো বারবার ছুটে আসি দুই দেশের বাঙালী বাংলাভাষী মানুষের পাশে।বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হলো। মিষ্টি বিতরণ, আলোচনা আর গানে গানে মাতোয়ারা হলো দুই বাংলার একই আকাশ একই বাতাস। উভয় দেশের জনপ্রতিনিধিরা বলেন, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ। নেতাদের কণ্ঠে ছিল ভবিষ্যতে আরো বড় করে এক মঞ্চে একুশ উদ্যাপনের প্রত্যাশা। উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শতস্ফুর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। নানা রং এর ফেস্টুন, ব্যানার, প্লা¬কার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্নিল সাজে সাজানো হয় নোম্যান্সল্যান্ড এলাকা। দু‘বাংলার মানুষের এ মিলন মেলায় উভয় দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছরই দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এ অংশের বাসিন্দারা এক সাথে মিলিত হয়ে দিবসটি পালন করেন। তখন দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ওই স্থানে আবেগ আপ্লু¬ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আলিঙ্গন করে সকল ভেদাভেদ যেন ভুলে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফুলের মালা ও জাতীয় পতাকা বিনিময় করে উভয় দেশের আবেগপ্রবণ অনেক মানুষ। বাঙালীর নাড়ির টানে একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। দুই বাংলার মানুষের মাঝে বসে এক মিলন মেলা। এ সময় পেট্রাপোল ও বেনাপোল চেকপোস্টে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষনিকের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা।
সকাল সাড়ে ১০ টা সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রি শ্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লি¬ক, বনগাঁ লোকসভার সাংসদ শ্রীমতি মমতা ঠাকুর,উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাধিপতি রেহেনা খাতুন, বনগাঁ উত্তরের বিধান সভার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস,বনগাঁ দক্ষিনের বিধান সভার বিধায়ক শ্রী সুরজিৎ দাস এর নেতৃত্বে ভারত থেকে আসা শতশত বাংলাভাষী মানুষ বাংলাদেশীদের ফুলের পাঁপড়ী ছিটিয়ে ও মিস্টি দিয়ে বরণ করে নেয় একে অপরকে। নোমান্সল্যান্ডে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে প্রথম ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রি শ্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লি¬কসহ ভারত থেকে আগত সকল মেহমানগণ। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শ্রী পিযুষ কান্তি ভট্রাচার্য,যশোর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন,সাধারন সম্পাদক শাহিন চাকলাদার,যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ, ,যশোর ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল আরিফুল হক,শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুলোক কুমার মন্ডল,বেনাপোল কাষ্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ মারাফুর রহমান,বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি অপূর্ব হাসান।২১ শের মঞ্চে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন ও বনগাঁ পৌরসভার মেয়র শ্রী শংকর আঢ্য।
এ সময় উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শতস্ফুর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। ভাষা দিবসের মিলন মেলায় বিজিবি বিএসএফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছ জানায়। এর পর দু’দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে যৌথভাবে। এ সময় ভাষার টানে বাঙালির বাঁধন হারা আবেগের কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দু‘বাংলার মানুষ। এর মধ্য দিয়ে বোঝা গেল রফিক, শফিক, জব্বার,বরকত ও সালামের তরতাজা রক্ত বৃথা যায়নি। ভাষার আকর্ষণ ও বাঙালির নাড়ির টান যে কতটা আত্মিক ও প্রীতিময় হতে পারে তাও বুঝিয়ে দিল মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই সঙ্গে এপার-ওপার দুই বাংলার গণমানুষের ঢল ফের প্রমাণ করে দিলো দেশ ভাগ হলেও ভাগ হয়নি ভাষার। উভয় দেশের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি এখনো যে অটুট রয়েছে তাও বোঝা গেল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই বাংলার অতিথিদের বক্তৃতায়।
একুশ উদ্যাপন কমিটির সভাপতি বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বলেন, ৫২ এর ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বৃটিশরা আমাদের বাংলা ভাষাকে বিভক্ত করতে পারেনি। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে আমাদের এই ভাষা আন্দোলন। দেশের সন্তানরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছে তাদেরকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরন করবে। ভাষা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের দুই দেশের মধ্যে উপস্থিত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভীতকে আরো শক্ত করবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লি¬ক বলেন, আপনারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ভাষা আর স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগের নজির পৃথিবীতে অন্য কোন দেশের নেই। এ জন্য আপনারা গর্বিত জাতি। ভাষার টানে আমরা বাংলাদেশে ছুটে এসেছি একুশ উদ্যাপন করতে। দু‘বাংলার মানুষ একসাথে মাতৃভাষা দিবস পালন করছে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। ভবিষ্যতে দু‘বাংলার ভাষা প্রেমীদের সাথে নিয়ে আরো বড় করে একুশ উদযাপন করবো এটাই আমার প্রত্যাশা। আজ বাংলা ভাষা সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করে যারা আত্মহুতি দিয়েছে পৃথিবীতে এমন দেশ নজিরবিহীন। আর সে জন্যই বাংলাদেশের বাঙালীরাই পেরেছে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য। একুশ যেমন দুঃখের দিন, তেমনি গর্বের ও দিন। দু-বাংলার মানুষের মিলন মেলার মধ্য দিয়ে দু-দেশের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হবে। আমরা এসেছি অন্তরের টানে।আমরা হিন্দু কিংবা মুসলিম নয় আমরা বাঙালী জাতি। দেশ বিভক্তি হলেও ভাষার পরিবর্তন হয়নি। আমরা ওপারে থাকলেও শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। তিনি আরো বলেন, বিধির কারনে আমাদের বাংলা দু‘বাংলায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এ বেদনা আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। একে অপরকে আলিঙ্গন করা ইচ্ছা আছে কিন্তুু মাঝখানে সীমারেখার কারণে তা সম্ভব হয় না। আমরা দুই দেশের সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি আগামী দিনগুলোতে ও যেন একই মঞ্চে বসে যাতে এই অনুষ্ঠান করতে পারি।
মঞ্চে একুশের কবিতা আবৃতি, ছড়া, গীতিনাট্য, আলোচনা আর সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভাষা শহীদদের স্মরনে দু’বাংলার মানুষের সম্প্রতি আর ভালোবাসার বাধনকে আরো সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে বিকেলে শেষ হবে ভাষা প্রেমিদের মিলন মেলা। সমগ্র অনুষ্ঠানে নেয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় দুই সীমান্তে। বেনাপোল পেট্রাপোল চেকপোস্টে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবি-বিএসএফ অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে দুই সীমান্তে। সীমান্ত টপকে যাতে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ বাঁশের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২০০২ সাল থেকে অর্থ্যাৎ ১৭ বছর দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল চেকপোস্টের জিরো পয়েন্টে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে দু‘বাংলার মানুষ। #